মো. আবদুল আউয়াল হেলাল
২০০১ সালের ৩ আগস্ট জকিগঞ্জ লেখক পরিষদ আয়োজন করে লেখক সম্মেলন। জকিগঞ্জের ইতিহাসে প্রথম লেখক সম্মেলনে প্রধান অথিতি ছিলেন প্রফেসর কবি আফজাল চৌধুরী। প্রধান বক্তা ইতিহাসবিদ খ্যাত মনির উদ্দিন চৌধুরী। বিশেষ অথিতি ছিলেন কবি কালাম আজাদ, প্রফেসর সুনির্মল কুমার দেব মীন, সৈয়দ মস্তফা কামাল, আবদুল হামিদ মানিক, কবি কিশওয়ার বিন দিলওয়ার, কবি শারিক শামসুল কিবরিয়া। অন্যান্যের মধ্যে ছিলেন কবি মাজেদ আহমেদ চঞ্চল, দেওয়ান মাহমুদ রাজা চৌধুরী, কবি লায়েক আহমদ নুমান, ছড়া শিল্পী মতিউল ইসলাম মতিন, কবি আবদুল কাইউম, গল্পকার শাহেদ আহমদসহ সিলেটের একঝাঁক তরুণ সাহিত্য কর্মী। নতুন সাহিত্য সংগঠন জকিগঞ্জ লেখক পরিষদ'র বর্ণাঢ্য সে আয়োজন ব্যাপক প্রশংসিত হয়। স্বদেশ ভালোবেসে সন্ত্রাস রুখো শ্লোগান খচিত ব্যানার নিয়ে ডাকবাংলো প্রাঙ্গন থেকে উপজেলা অডিটরিয়াম পর্যন্ত লেখক শুভাযাত্রা বোদ্ধা মহলের নজর কাডে। ৩ আগস্ট অনুষ্ঠিত লেখক সম্মেলনের রেশ কাটার আগেই ৭ আগস্ট পাড়ি জমাই লন্ডন। স্মৃতিময় দিনগুলো পেছনে পড়ে থাকে। পরিকল্পনা করলাম যখনি দেশে ফিরবো আবারো জকিগঞ্জে আয়োজন করবো লেখক সম্মেলন। টার্গেট করলাম বর্তমান বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ কবি আল মাহমুদ হবেন সে সম্মেলনে প্রধান অথিতি। ঢাকায় যোগাযোগ শুরু করলাম। কবি সাথে পূর্ব পরিচিতি নেই, তদুপরি কথা বললাম টেলিফোনে। কবি আশ্বাস দিয়ে বললেন- সময়মত যোগাযোগ করবেন, দেখা যাবে। প্রবাস জীবনের বর্ষপূর্তির আগেই ২০০২ সালের জুলাই মাসের শেষ দিকে দেশে ফিরলাম স্বস্ত্রীক। তিন দিন পর জকিগঞ্জ লেখক পরিষদ'র বৈঠক হলো। দ্বিতিয় লেখক সম্মেলন আয়োজন বিষয়ে ব্যাপক আলোচনা হলো। সম্ভাব্য তারিখ ঠিক হলো ৬ সেপ্টেম্বর, শুক্রবার। সপ্তাহ দুয়েক পর ঢাকায় গেলাম। দেখা করলাম দৈনিক ইনকিলাবের তৎকালিন সিনিয়র সহসম্পাদক শ্রদ্ধেয় ইউসুফ শরীফ'র সাথে। ইনকিলাব অফিসে তাঁর রুমে দীর্ঘ আলোচনা হলো। ইউসুফ ভাইকে নিয়ে গেলাম কবি আল মাহমুদের বাসায়। সব শোনে কবি জকিগঞ্জ আসতে সম্মত হলেন। বিশেষ অথিতি হিসেবে আমন্ত্রণ গ্রহন করলেন কবি আবিদ আজাদ, গল্পকার ব্রিগেডিয়ার (অব:) আবুবকর সিদ্দিকী ও ইউসুফ শরীফ। ঢাকা থেকে ফিরে জকিগঞ্জ লেখক পরিষদের জরুরী বৈঠকে প্রধান অথিতি কবি আল মাহমুদ ও অন্য অথিতিদের সম্মতির বিষয় জানালাম। সবাই উৎফুল্ল। শুরু হলো কর্ম তৎপরতা। ছুটে গেলাম প্রফেসর কবি আফজাল চৌধুরীর বাসায়। স্যার খুবই খুশি হলেন। তবে অসুস্থতার কারণে জকিগঞ্জ পর্যন্ত দীর্ঘপথ গাড়িতে বসা সম্ভব হবেনা জানালেন। সম্মেলন স্মারকে প্রকাশের জন্য নতুন লেখা একটি কবিতা দিলেন। পর্যায়ক্রমে যোগাযোগ হলো কবি কালাম আজাদ, আবদুল হামিদ মানিক ও মাজেদ আহমেদ চঞ্চলের সাথে। সবাই সানন্দে অংশগ্রহনে রাজি হলেন। জকিগঞ্জ লেখক পরিষদের বিভন্ন দায়িত্বশীল যেমন-অধ্যক্ষ মাওলানা আবদুল হাকীম, কবি মহিউদ্দিন হায়দার, মাওলানা ফদ্বলুর রাহমান, পিয়ার মাহমুদ, এজেএম শিহাব, ইকবাল আহমদ চৌধুরী, সেলিম আহমদ, মাহবুবুর রহীম, আহমদ ছিদ্দিক চৌধুরী হাছান, শাহীদ আহমদ, নুমানুর রাহমান চৌধুরী, গুলজার আহমদ, ইয়াহইয়া চৌধুরী প্রমূখের কর্মতৎপরতা লেখক সম্মেল সফলের মূল চালিকাশক্তি ছিলো। এ পর্যায়ে তিনজন মানুষের নাম শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করতে চাই। জকিগঞ্জ লেখক পরিষদের সদস্য না হয়েও তাঁরা যে সর্বাত্মক নির্দেশনা এবং শ্রম দিয়েছেন তা না হলে লেখক সম্মেলন সফলভাবে সম্পন্ন হতো কি না সন্দেহ। তাঁরা মাওলানা মুহাম্মাদ হাসান চৌধুরী ফুলতলী, মরহুম মাহতাব আহমদ ও মাওলানা জইন উদ্দিন। সম্মেলনের দিন ঘনিয়ে এলো। ব্যাপক প্রচারণার ফলে জকিগঞ্জের শিক্ষিত মহলে সাড়া পড়ে গেলো। বিশেষ করে তরুণদের মাঝে ব্যাপক উৎসাহ পরিলক্ষিত হলো। সম্মেল স্মারকের জন্য সংগৃহিত লেখা নিয়ে মহিউদ্দিন হায়দার, পিয়ার মাহমুদ ও আমি আবারো ঢাকা গেলাম। স্মারকের ডিজাইন, প্রুফ রিডিং পরিপাটি ছাপা ইত্যাদিতে দু'জন মানুষের মেধা এবং শ্রম স্মরণীয় হয়ে আছে। তাঁরা হলেন মাসিক পরওয়ানার তৎকালীন সহসম্পাদক মাওলানা ফরিদ আহমদ চৌধুরী ও গ্রাফিক্স ডিজাইনার ওবাইদুল হক।
সে যাত্রা ঢাকার অথিতিগণের সাথে আবারো যোগাযোগ করে সব ফাইন্যাল করা হলো। সিদ্ধান্ত মত কবি আল মাহমুদের যাতায়াতের বিমান টিকেট পৌঁছে দিলাম। ইউসুফ ভাই দায়িত্ব নিলেন কবি আবিদ আজাদ ও গল্পকার আবুবকর সিদ্দিকীকে নিয়ে ৫ সেপ্টেম্বর রাতের ট্রেনে সিলেটের পথে রওয়ানা দেবেন। ৫ সেপ্টেম্বর, বৃহস্পতিবার বিকেলের ফ্লাইটে কবি আল মাহমুদ সিলেট পৌঁছেন। এয়ারপোর্ট থেকে কবিকে নিয়ে আসা হলো সুবহানীঘাট হোটেল ইস্টার্ন গেইটে। এখানেই রাতে অবস্থান করবেন। রাতে কবিসহ আমাদের দাওয়াত ছিলো বিশিষ্ট ব্যবসায়ি সৈয়দ খলিলুর রহমান (খলন মিয়া )'র বাসায়। যথা সময়ে আমরা কবিকে নিয়ে গেলাম। খাবার পর খলন মিয়ার উপশহরের বাসায় দীর্ঘ আড্ডা হলো। কবিকে হোটেলে পৌঁছে দিয়ে ঢাকার অন্য অথিতিদের ট্রেন স্টেশন থেকে রিসিভ, সকালে ঢাকা এবং সিলেটের অথিতিদের জকিগঞ্জ নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা পাকাপুক্ত করে গভীর রাতে বাড়ি ফিরলাম। সকালে যথা সময়ে অনুষ্ঠানের প্রথম অধিবেশনের কাজ শুরু হলো। শুরু থেকেই উপচে পড়া ভীড় আমাদেরকে আশান্বিত করলো। পূর্বনির্ধারিত কর্মসূচি মত দুপুরের খাওয়ার জন্য অথিতিদের আমাদের বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হলো। খাওয়ার পর কবি আল মাহমুদ আব্বার (শায়খুল হাদীস আল্লামা মো. হবিবুর রহমান হাফিযাহুল্লাহ) সাথে দীর্ঘ সময় বিভিন্ন বিষয়ে আলাপ করলেন। অনুষ্ঠান সমাপ্ত হবে বিকেল পাঁচটায় এমন সিদ্ধান্ত ছিলো। কিন্তু অথিতি এবং শ্রোতাদের আগ্রহ বিবেচনায় সময় বর্ধিত করতে হলো। কবি আল মাহমুদ মাগরিব নামাযের পর বক্তব্য শুরু করলেন। দেড় ঘন্টারও বেশি সময় চললো তাঁর তাৎপর্যপূর্ণ বক্তব্য। অনুষ্ঠান শেষ হলে কবি আল মাহমুদসহ অন্য অথিতিদের নিয়ে আমরা গেলাম ফুলতলী ছাহেব বাড়ি। চা পর্বের পর কবি কালাম আজাদ ছাড়া সিলেটের অথিতিরা চলে গেলেন। ঢাকার অথিতিরা রাতে ফুলতলী ছাহেব বাড়িতে অবস্থান করবেন। এ পর্যায়ে অথিতিদের নিয়ে আমি ও কবি কালাম আজাদ ভেতর বাড়িতে গেলাম। কবি আল মাহমুদসহ অন্যান্যরা ছাহেব কিবলা (রহ.)কে কদমবুছি করলেন। ছাহেব কিবলা খুবই আগ্রহ সহকারে কবি আল মাহমুদের সাথে দীর্ঘক্ষণ বিভিন্ন বিষয় আলাপ করলেন। সে আলাপচারিতা আমি ভিডিও ধারণ করলাম। কবি আল মাহমুদ তন্ময় হয়ে ছাহেব কিবলার চেহারার দিকে চেয়ে থাকলেন। রাতের খাবার প্রস্তুত। ছাহেবজাদগণের মধ্যে তৃতিয় মাওলানা শিহাব উদ্দিন চৌধুরী ও কনিষ্ঠ মাওলানা হুছামুদ্দিন চৌধুরী অথিতিদের নিয়ে খাবার টেবিলে বসলেন। মাওলানা মুহাম্মাদ হাসান চৌধুরীর নেতৃত্বে ছাহেব কিবলার নাতিগণ অথিতি আপ্যায়নে ব্যস্থ সময় কাটালেন। খাবার পর কবি আল মাহমুদ আমায় কাছে ডেকে বললেন- তোমার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। তুমি আমাকে রাইট জায়গায় নিয়ে এসেছো। অনেকে আমাকে বান্ধা বকরি মনে করে, আসলে আমি তা নয়। কবি সেই তাৎপর্যপূর্ণ ইঙ্গিতবাহি কথা আজো কানে বাজে। পরদিন সকাল এগারোটার দিকে অথিতিদের নিয়ে সিলেটের পথে ফুলতলী থেকে বেরিয়ে পড়লাম। বিমান বন্দরে পৌঁছে দিয়ে ফিরে এলাম আমরা। উৎসব মুখর একটি দিন জকিগঞ্জের সাহিত্য চর্চার ইতিহাসে স্মৃতি হয়ে রইলো।
কৈফিয়ত : লেখাটি স্মৃতি নির্ভর এবং অসম্পূর্ণ। তাই কারো নাম বা সম্মেলনে তাঁর ভূমিকার কথা বাদ পড়তে পারে। সে জন্য ক্ষমাপ্রার্থী ।
লেখক: প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি- জকিগঞ্জ লেখক পরিষদ, সিলেট।
0 মন্তব্য:
Speak up your mind
Tell us what you're thinking... !