ইসলাম মানবজীবনের একটি পরিপূর্ণ ও সামগ্রীক জীবনাদর্শ। এতে রয়েছে মানুষের জীবনের ভিন্ন স্তরের জন্য সুস্পষ্ট ও সুনির্দিষ্ট নীতি ও নির্দেশ। আল্লাহ তা’য়ালা বলেন, “নিঃসন্দেহে ইসলামই আল্লাহ তা’আলার মনোনীত একমাত্র দীন।” (সূরা - ইমরান) ইহকালীন শান্তি ও পরকালীন মুক্তির গ্যারান্টি দিতে পারে একমাত্র ইসলামই। ইসলাম যুক্তিবিরোধী, প্রগতি-বিমুখ বা অন্ধবিশ্বাস নির্ভর ধর্ম নয়। তাই ইসলাম ধর্ম কখনো কুসংস্কার সমর্থন করেনা কিন্তু বর্তমানে আধুনিকতার নামে, তথায় অন্ধ বিশ্বাসের ফলে ইসলামে কুসংস্কারের প্রবেশ প্রতিনিয়ত হচ্ছে। যার ফলশ্রুতিতে মুসলমানদের ঈমান আকিদার ধ্বংস হচ্ছে। কুসংস্কার সমাজ দেহের জন্য মারাত্মক ব্যাধি। এর থেকে বাঁচা ঈমানের অপরিহার্য দাবী। বর্তমানে বিভিন্ন আচার অনুষ্ঠানে ও সংস্কৃতিতে কুসংস্কার ঘিরে রয়েছে। কুসংস্কার হল ঃ যে সব কাজ দেশপ্রথা ও রেওয়াজের ভিত্তিতে করা হয় এবং যা শরীয়ত অনুমোদীত ও সমর্থিত নয় বরং কোন কোন সময় শরীয়তের পরিপন্থী ও হয়ে থাকে এইসব কাজই কুসংস্কার। বাংলাদেশে প্রচলিত কিছু কুসংস্কার সংক্রান্ত বিষয় সম্পর্কে নি¤েœ আলোচনা করা হল-
মৃত্যু পরবর্তীকালীন কুসংস্কার সমূহ :
মানুষ তার প্রিয়জন তথায় আত্মীয়স্বজনের মৃত্যুতে ব্যথিত হবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু ইসলাম এর জন্য একটা সীমারেখা ও নির্ধারণ করে দিয়েছেন। কিন্তু এই সীমারেখা অতিক্রম করে, কারো মৃত্যুও পর তার বাড়িতে উপস্থিত হয়ে পুরুষ-মহিলা মিলে হাউমাউ করে উচ্চঃস্বওে বিলাপ করা, বুক চাপড়িয়ে জামা-কাপড় ছিড়ে ফেলা গুনাহের কাজ। রাসূল (সাঃ) তা নিষেধ করেছেন। হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলিয়াছেন, হুজুর পাক (সাঃ) বিলাপকারী কে এবং তাহা শ্রবণকারীকে অভিসম্পাত করিয়াছেন। (আবু দাউদ) মিশকাত হাদীস নং ১৬৪০। হযরত আবু মালেক আশআরী (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলিয়াছেন, হুজুর পাক (সাঃ) এরশাদ করিয়াছেন, আমার উম্মতের মধ্যে অন্ধকার যুগের চারটি বিষয় এখনও রহিয়াছে, যাহা তাহারা এখনও পরিত্যাগ করিতেছে না। যথা : (১) নিজের গুণের গৌরব, (২) কাহারও বংশের নিন্দা, (৩) গ্রহ-নক্ষত্রের মাধ্যমে বৃষ্টি কামনা করা এবং (৪) বিলাপ করিয়া ক্রন্দন করা। ইহার পর তিনি বলিলেন, বিলাপ কারিনী যদি তাহার মৃত্যুর পূর্বে তাওবাহ না করে, রোজ কিয়ামতে তাহাকে আলকাতরার জামা এবং ক্ষতবিশিষ্ট শরীরসহ উঠান হইবে। [মুসলিম, মিশকাত হাদীস নং ১৬৩৫]
পোশাক-পরিচ্ছদে কুসংস্কার :
পোশাক হল নারী-পুরুষের শরীয়ত মতে ছতর ঢাকা, তথা সৌন্দর্যের বহিঃপ্রকাশ পোশাক-আশাক, চাল-চলন, আহার-বিহার ইত্যাদিতে বিধর্মীদের অনুসরণও কুসংস্কারের অন্তর্ভূক্ত। বর্তমানে ছাত্র/ছাত্রীদের দেখা যায়, বিধর্মীদের পোশাকের প্রতি বেশী আকৃষ্ট হয়ে পড়েছে। সেটা কি ইসলাম আদৌ সমর্থন করে কিনা তা তারা চিন্তা করেনা। হযরত ইবনে উমর (রাঃ) হতে বর্ণিত রয়েছে রাসুল (সাঃ) বলেন, যদি কেউ ভিন্ন ধর্মাবলম্বী কোন জাতির অনূসরণ করে তবে সে ঐ জাতির অন্তর্ভূক্ত বলে গণ্য হবে। (আবু দাউদ) সামাজিকতা, সাধারণ অভ্যাসাদি এবং জাতীয় বৈশিষ্ট্য সমূহের ক্ষেত্রে বিজাতীয় অনুকরণ মাকরুহ তাহরীমী। যেমন, খ্রিষ্টানদের টুপি, হিন্দুদের ধুতি এবং বৌদ্ধদের লাল কাপড়ের তৈরী পোশাক। এ ধরনের পোশাক ব্যবহার করা ইসলামী শরীয়তে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। যে সব জিনিস বিজাতীয় বৈশিষ্ট্যরূপে পরিগণিত এসব বিষয়ের ক্ষেত্রে বিজাতীয় অনুকরণ কোনক্রমেই জায়েজ নেই। [ইসলাহুর রুসুম, পৃষ্টা-২৩]
লেবাসের ক্ষেত্রে পুরুষের জন্য মহিলাদের অনুকরণ এবং মহিলাদের জন্য পুরুষের অনুকরণ সম্পূর্ণরূপে হারাম। শহর-গ্রামে আজ লেবাসে নারী-পুরুষ পার্থক্য করা কঠিন ব্যাপার। এই কাজ জান্নাত প্রবেশে প্রতিবন্ধক। হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) এর বর্ণনা তিনি বলেন, রাসুল (সাঃ) বলেছেন, যেসব পুরুষ মহিলাদের বেশ ধারণ করে এবং যেসব মহিলা পুরুষের বেশ ধারণ করে আল্লাহ তাদের উভয়ের প্রতি অভিসম্পাত করেন। (বুখারী) রেশমী কাপড় পরা, স্বর্ণের আংটি ব্যবহার করা পুুরুষের জন্য হারাম। হাফ প্যান্ট পরিধান করা পুরুষ-মহিলা সকলের জন্য হারাম। হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুল (সাঃ) বলেছেন, রেশমী বস্ত্র পরিধান করনা, কেননা যারা দুনিয়াতে তা পরিধান করবে, তারা আখিরাতে তা পরিধান করতে পারবে না। (বুখারী/মুসলিম) আবু মূসা আশআরী (রাঃ) সূত্রে বর্ণিত, রাসূল (সাঃ) বলেছেন, রেশম ও সোনা ব্যবহার আমার উম্মতের পুরুষদের জন্য হারাম করা হয়েছে এবং তাদের নারীদের জন্য হালাল করা হয়েছে। (তিরমিযি) টাখনু-গিরা আবৃত করে পায়জামা এবং ফুলপ্যান্ট পরিধান করাও পুরুষের জন্য হারাম। হযরত আবু হুরাইরা হইতে বর্ণিত রয়েছে, রাসুল (সাঃ) বলেন, টাখনুর নীচের যেই অংশ পায়জামা বা লুঙ্গিঁ দ্বারা ঢাকা থাকে , তাহা দোযখে যাইবে। [মিশকাত হাদীস নং ৩৭৩]
শবে বরাতে কুসংস্কার :
ইবাদতের রাত্রে হালুয়া-রুটি ব্যবস্থা করা জরুরী মনে করা কুসংস্কারের অন্তর্ভূক্ত। শবে-বরাতে বাড়িঘর ও মসজিদে আলোকসজ্জার ব্যবস্থা করা, ফটকা বা বোমা ফাটানো ও মরিচ বাতি ও তারা বাতি জ্বালিয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ানো ও কুসংস্কারের অন্তর্ভূক্ত। এতে নিজের ইবাদতে বিঘœ সৃষ্টি হয়। ইবাদতের পরিবেশ নষ্ট হয় এবং টাকা পয়সার অপচয় ও অপব্যয় হয়। ইসলাম অপচয়কে পছন্দ করেনা। আল্লাহ তা’আলা বলেন, “নিশ্চয়ই অপচয়কারী শয়তানের ভাই”(সূরা-বনি-ইসরাইল)
বিবাহ-শাদীতে কুসংস্কার :
পাত্র-পাত্রী নির্বাচন বিয়ে-শাদীর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। দাম্পত্য জীবনের পরিধি যেমন খুবই ব্যাপক এর সমস্যাও অীত বিস্তৃত। স্বামী স্ত্রীর মধ্যে যদি স্পষ্ট বাহ্যিক সামাজিক দৃষ্টিতে প্রকট কোন ব্যবধান ও অসামঞ্জসা থাকে অনেক ক্ষেত্রেই তা আর কাটিয়ে ওঠা সম্ভবপর হয়না। তাই বিবাহ শাদীর পূর্বে পাত্র কর্তৃক প্রয়োজনে পাত্রীকে দেখে নেওয়া জায়েজ। এ পর্যায়ে সর্বপ্রথম দলীল হচ্ছে কুরআন মাজীদেও নি¤েœাক্ত বাণী- তোমরা বিয়ে করো সেই মেয়েলোক, যাকে তোমার ভাল লাগে- যে তোমার পক্ষে ভালো হবে। [আল-কুরআন, সূরা নিসা] নবী করীম (সাঃ) বলেন, তোমাদের কেউ যখন কোনো মেয়ে বিয়ে করার প্রস্তাব দেবে তখন তাকে নিজ চোখে দেখে তার গুণ ও বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে ধারনা করে নিতে অবশ্য চেষ্টা করবে, যেন তাকে ঠিক কোন আকর্ষণে বিয়ে করবে তা স্পষ্ট বুঝতে পারে। (আবু দাউদ) কিন্তু বর্তমান সমাজে কুসংস্কার প্রচলন আছে পাত্রী নির্বাচনে, ভগ্নিপতি, চাচাতো ভাই, মামাতো ভাই, দাদা, নানা, চাচা, মামা, খালাতো ভাই এক কথায় মাহরাম, গায়রে মাহরাম সকলে মিলে দেখার অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করা শরীয়তের দৃষ্টিতে না জায়েজ। বিবাহ-শাদীর অনুষ্ঠানে নাচ-গান করা হারাম। এমনিভাবে ব্যান্ড পার্টির দ্বারা বা যেকোনভাবে ঢোল-তবলা বাজানো ও সম্পূর্ণরূপে হারাম। সমাজে দেখা যায়, বরকে গোসলের সময় তার ভাবী, খালাতো/মামাতো/চাচাতো/ফুফাতো বোনেরা গোসল করা, তা সম্পূূর্ণ নাজায়েজ। তেমনিভাবে গায়েরে মুহরাম পুরুষেরা কনেকে গোসল করানোর প্রচলন সমাজে প্রচলিত। তাও নাজায়েজ। গোসল অনুষ্ঠানের শুরুতে সবার অগ্রভাগে তেল দিয়ে প্রদীপ জ্বালিয়ে গোসল আরম্ভ করা কুসংস্কারের অন্তর্ভূক্ত। বিবাহের অনুষ্ঠানে কনের পিতা উপস্থিত থাকা অবস্থায়ও অন্য কাউকে উকিল নিয়োগ করা সামাজিক কুপ্রথার অন্তর্ভূক্ত। এমনিভাবে মাহ্রামের সাথে গায়রে-মাহরাম লোকদের কে নিয়ে কনের কাছ থেকে ইযন আনা এক ধরনের কুসংস্কার।গায়রে-মাহরাম লোকদের কনের কাছে যাওয়া সম্পূর্ণরূপে হারাম।
গান বাজনা :
আমাদের সমাজে অনেক অনৈসলামিক অনুষ্ঠানের আয়োজন হয়ে থাকে। তার মধ্যে গানের অনুষ্ঠান অন্যতম। অনেকে বিয়ে, মুসলমানি (খতনা), আকিকা, এই সকল সুন্নত এ রাসুল (সাঃ) অনুষ্ঠানে আজকাল গানের আয়োজন করে অথচ ইসলামের দৃষ্টিতে এই কাজ কুসংস্কার তথায় ইসলামী বিরোধী কাজ। কোথাও আবার অনেকে মিলে যাত্রা গান, কোথাও পালা গান, আবার কোথাও সাধারণ গানের অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। এসব গানের অনুষ্ঠানে থাকে সারেঙ্গী, বেহালা, হারমোনিয়াম, বাঁশী, দোতারা, সেতারা, ঢোল-তবলা ইত্যাদি বাদ্যযন্ত্র। গান এবং বাদ্যযন্ত্র সব কিছুই শরীয়তের দৃষ্টিতে হারাম। আবার আল্লাহ , রাসুল (সাঃ) গুণগান তথায় ইসলামী সংগীত ইত্যাদি জায়েজ। আল্লাহ বলেন, মানুষের মধ্যে কেউ কেউ অজ্ঞাতবশত আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুৎ করার জন্য অবাস্তব কথাবার্তা সংগ্রহ করে এবং এ নিয়ে ঠাট্রা-বিদ্রুপ করে, তাদের জন্য রয়েছে অবমাননাকর শাস্তি। (সূরা- লোকমান ৬) হযরত আবদুল্লাহ (ইবনে মাসউদ) (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসুল (সাঃ) কে বলতে শুনেছি, গান বাদ্য অন্তরে নিফাক সৃষ্টি করে। (আবু দাউদ হাদীস নং ৪৯২৭) হযরত আবু উমামা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুল (সাঃ) গায়িকাদের ক্রয়-বিক্রয়, তাদের উপার্জন ও তাদের মূল্য খেতে নিষেধ করেছেন। (ইবনে মাযাহ, হাদীস নং ২১৬৮) উপর্যুক্ত আলোচনা থেকে আমরা শিক্ষা পাই (মুসলমানরা) রাসুল (সাঃ) এর নির্দেশিত পথ ছাড়িয়ে, কুসংস্কার গ্রহণ করা মোটেই উচিত নয়। আমাদের প্রত্যেকটি কাজ হওয়া দরকার একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে দুনিয়ার চাকচিক্য ক্ষণস্থায়ী। তাই প্রত্যেকটি কাজই হবে শুধু ইসলামের দৃষ্টিকোণ থেকে, অন্য কোন দৃষ্টি কোনে মুসলমানদের কাজ করা মোটেই সমীচিন নয় তাই আল্লাহ কুরআনে ঘোষণা করেছেন- “যে ব্যক্তি ইসলাম ছাড়া অন্য কোনো দীন অবলম্বন করতে চায়, তার সে দিন কিছুতেই গ্রহণ করা হবে না। আর পরকালে রয়েছে তার জন্য ব্যর্থতা আর বঞ্চনা। (আল ইমরান-৮৫)
লেখক: মোঃ হাবিবুল্লাহ বাহার, প্রভাষক-ইছামতি ডিগ্রি কলেজ ও পি-এইচ,ডি গবেষক, মোবাইল-০১৭১৪-৫২৮৬৭২
0 মন্তব্য:
Speak up your mind
Tell us what you're thinking... !