গত ৪ জানুয়ারি সোমবার ভোররাতে জকিগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে শক্তিশালী ভূমিকম্প আঘাত হেনেছে। বড় ধরনের ঝাঁকুনির কারণে মানুষ আতংকগ্রস্ত হয়ে পড়ে। আতংকে দেশের বিভিন্ন স্থানে কয়েকজনের মৃত্যুর খবরও পাওয়া গেছে। ভবন থেকে হুড়োহুড়ি করে নামতে গিয়ে আহত হয়েছেন অনেকে। জকিগঞ্জ পৌর শহরের নিশাত প্লাজা নামের একটি ভবন কিছুটা হেলেছে। এছাড়া উপজেলার বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি স্থাপনায় কিছুটা ফাটল দেখা দিয়েছে। তবে স্বস্তির কথা, ভূমিকম্পের ঝাঁকুনি যত তীব্র ছিল, সে তুলনায় ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে কম। ধারণা করা যায়, কম্পন দীর্ঘস্থায়ী হলে বড় ধরনের বিপর্যয় ঘটত। এ ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ভারতের মনিপুর রাজ্য। সেখানকার ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ অনেক। কয়েক মাস আগে, গত বছর ২৫ এপ্রিল, জকিগঞ্জসহ পুরো দেশে আরেকটি বড় মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছিল। ওই ভূমিকম্পের বড় আঘাতটি লাগে প্রতিবেশী দেশ নেপালে। ব্যাপক বিধ্বংসী ওই ভূমিকম্পে বেসরকারি হিসাবে ১০ হাজারেরও বেশি মানুষ নিহত হয়। বিশেষজ্ঞরা দীর্ঘদিন ধরে বলে আসছেন, বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বের অন্যতম ভূমিকম্পপ্রবল অঞ্চলে। তাছাড়া ১০০ বছরের ভূমিকম্পের সাইকেল অনুযায়ী দেশে একটি উচ্চ মাত্রার ভূমিকম্পের আশংকা রয়েছে। কাজেই যেভাবে জকিগঞ্জ পৌর শহরসহ উপজেলার বিভিন্ন স্থানে জাতীয় বিল্ডিং কোড না মেনে অপরিকল্পিতভাবে ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে তাতে মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্পও একটু অধিক সময় স্থায়ী হলে ঘটে যেতে পারে প্রলয়ংকরী ধ্বংসলীলা। বেশ কয়েক বছর থেকে জকিগঞ্জে গুরুত্বপূর্ণ বেশ কয়েকটি সরকারি ভবন ভূমিকম্পের চরম ঝুঁকিতে রয়েছে বলে লেখা লেখি হচ্ছে। কিন্তু তাতে কারোও টনক নড়ছে না। এ সকল ঝুঁকিপূর্ণ সরকারি ভবনে জীবনের ঝুঁকি নিয়েও বাধ্য হয়ে প্রতিদিন শতশত জনসাধারণ নিজেদের প্রয়োজনে আসতে হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও ঝুঁকি নিয়ে দাপ্তরিক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন। চরম আতংকে থাকা স্বতেও এই ভবনগুলোতে বসে কাজ শেষ করতে হচ্ছে। পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন সূত্রে জানা যায়, জকিগঞ্জ উপজেলা পরিষদ ভবনটিও রয়েছে বেশ ঝুকিপূর্ণ অবস্থায়। দীর্ঘদিন থেকে ভবনের বিভিন্ন স্থানে ফাটল দেখা দিলেও ভূমিকম্পের পর থেকে আতংক বেড়ে গেছে। এতে চরম আতংকে রয়েছেন ভবনে অবস্থিত বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ আগন্তুক উপকারভোগী লোকজন। দু’তলা বিশিষ্ট জনগুরুত্বপূর্ণ এই ভবনটি দীর্ঘদিন এমন ঝুকিপূর্ণ অবস্থায় থাকলেও তা থেকে উত্তরণের ব্যবস্থা গ্রহণ করছেন না সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। ১৯৮০ সালে নির্মিত এ ভবনটি নির্মাণ ত্র“টির কারণে নির্মাণের কিছু দিনের মধ্যেই ফাটল দেখা দেয়। খসে পড়ে ছাদের পলেস্তরা। পরে মেরামত করা হলেও আতংক থেকেই যায়। একই সাথে জকিগঞ্জ সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট আদালত ভবনটিও চরম ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। ২০১১ সালের আগষ্টে বিচারকার্য চলা অবস্থায় হঠাৎ করে তৎকালিন বিচারক কুদরত-ই-এলাহির সামনে খসে পড়ে ছাদের পলেস্তরার টুকরো। অল্পের জন্য রক্ষা পান তিনি। পলেস্তরা খসে পড়ার শব্দে আতংকিত হয়ে পড়েন বিচারক, আইনজীবী, পেস্কার, পুলিশ-কর্মচারীসহ উপস্থিত জনসাধারণ। এ অবস্থাতেই সেখানে অনেক দিন বিচারকার্য চলার পর কোন মতে তা সংস্কার করা হয়। আদালত ভবনটি ১৯৮৩ সালে নির্মাণ করা হলেও কাজের মান ভালো না হওয়ায় তিন দশকের মাথায় ভবনটি এখন মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ। বৃষ্টি হলে ছাদ চুষে পানি পড়ে। দেয়ালগুলো স্যাঁত স্যাঁতে। খানে খানে খসে পড়ছে দেয়ালের আস্তরণ। অপরদিকে জকিগঞ্জ শুল্ক ষ্টেশনের মাধ্যমে সরকার বছরে লক্ষ লক্ষ টাকার রাজস্ব আয় করলেও শুল্ক ষ্টেশন ভবনটি বিগত কয়েক বছর থেকে চরম ঝুঁকিতে রয়েছে। ১৯৪৭ সালে ছোট পরিসরে অস্থায়ীভাবে ৫টি ঘর নির্মাণ করে শুল্ক স্টেশনটির কার্যক্রম চালু হয়। দীর্ঘ ৬৩ বছর ধরে সংস্কার বিহীন জরাজীর্ণ আধাপাকা ঘরগুলোতে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। দরজা জানালা ভাঙ্গা, ফেটে গেছে দেয়াল, খসে পড়ছে দেয়ালের আস্তরণ। ঝুঁকিপূর্ণ এ ঘরগুলোতে কর্মকর্তা কর্মচারীরা বসবাসও করছেন। এছাড়া আদালত সংলগ্ন জকিগঞ্জ বার সমিতির ভবন ও জকিগঞ্জ পোষ্ট অফিস ভবনসহ এ উপজেলার প্রায় অর্ধশতাধিক সরকারি ও বেরসরকারি স্থাপনা ভূমিকম্প ঝুঁকিতে রয়েছে। তাই এ ব্যাপারে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। বিপর্যয় ঘটে যাওয়ার পর টনক নড়ে লাভ নেই। ভূমিকম্প এমন একটি প্রকৃতিক দুর্যোগ যা কোনো রকম পূর্বাভাস ছাড়াই মুহূর্তকালের মধ্যে বদলে দিতে পারে একটি দেশ বা ভূখণ্ডের মানচিত্র। এ দুর্যোগ প্রতিরোধের উপায় আজ পর্যন্ত মানুষ আবিষ্কার করতে পারেনি। ফলে দুর্যোগপূর্ব প্রস্তুতিই এক্ষেত্রে একমাত্র ভরসা। ভূমিকম্প মোকাবেলার মতো শক্তিশালী অর্থনীতি আমাদের না থাকায় এর ঝুঁকি যথাসম্ভব কমিয়ে আনার দিকেই দৃষ্টি দিতে হবে আমাদের নীতিনির্ধারকদের।
0 মন্তব্য:
Speak up your mind
Tell us what you're thinking... !