উচ্চতর আদালতের নির্দেশনা এবং সংশ্লিষ্ট দুটি মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপন জারিসহ বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়ার পরও শিক্ষার্থী, বিশেষ করে শিশু শিক্ষার্থীদের ওপর শিক্ষকদের মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন বন্ধ হয়নি। বিশেষ করে গ্রামীণ এলাকায় এর মাত্রা শহরের চেয়ে অনেকটা বেশী। গত ১৫ ফেব্র“য়ারি জকিগঞ্জ সংবাদের প্রথম পাতায় “জকিগঞ্জে শিক্ষিকার বেত্রাঘাতে শিক্ষার্থীরা হাসপাতালে” শিরোনামে প্রকাশিত সংবাদটি পড়ে অনেকের গা শিউরে ওঠে। প্রশ্ন জাগে আজকের দিনেও এমন হতে পারে? একজন শিক্ষিকার এ কোন নির্মমতা? যারা মানুষ গড়ার কারিগর তাদের আচরণ কেন এমনটি হবে? সংবাদটি পড়ে খোদ জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় হুইপ ও স্থানীয় সংসদ সদস্য আলহাজ্ব সেলিম উদ্দিন ক্ষোভ প্রকাশ করেন। প্রকাশিত সংবাদে জানা যায়, জকিগঞ্জের কলাকুটা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা আয়শা বেগম (নাসিমা) ‘পড়া না পারার’ অজৃহাতে তৃতীয় শ্রেণীর প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী তাহমিনা আক্তার, শারমিন আক্তার শাহী ও মীম আক্তারসহ কয়েকজনকে বেদরক বেত্রাঘাত করেন। তার বেত্রাঘাতে আহত একাধিক শিক্ষার্থীকে কালিগঞ্জ বাজারে চিকিৎসা দেওয়া হলেও শারমিন আক্তার শাহীকে জকিগঞ্জ সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে হয়। শুধু তাই নয়, সংবাদে উল্লেখ করা হয় শারমিন আক্তার শাহীর পিতা মোস্তফা আহমদ জানিয়েছেন, তার মেয়ের পিটে ১০/১২টি বেত্রাঘাত রয়েছে। প্রতিটি বেত্রাঘাতে তার পিটে রক্ত জমাট বেঁধে যায়। আমরা মনে করি, শিক্ষিকা আয়শা বেগম (নাসিমা) কোমলমতি শিক্ষার্থীদের যে দৈহিক নির্যাতন চালিয়েছেন তা আজকের দিনে ভাবা যায় না। আজকের দিনে, যখন সমাজ এগিয়ে যাচ্ছে, এগিয়ে যাচ্ছে মানুষ-তখন শিক্ষিকার বেত্রাঘাতে লিলা ফুলা জখম নিয়ে শিশু শিক্ষার্থী শারমিন আক্তার শাহী হাসপাতালে যাবে কেন? তার পড়া না পাওয়াটা কি এত বড় অপরাধ ছিল? এ লজ্জা শুধু ওই শিক্ষিকার নয়, গোটা সমাজ এবং দেশের সব শিক্ষকের। শিশু শারমিনের ওপর এ নির্মম নির্যাতনের ঘটনা আবারো আমাদের চোঁখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল, আমরা একটুও অগ্রসর হতে পারিনি। আমরা কেবলই পেছনের দিকে যাচ্ছি। কেননা শিক্ষার্থী নির্যাতনের ঘটনা আমাদের দেশে নতুন নয়। প্রায়ই আমরা মিডিয়ার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের শারীরিক নির্যাতনের সংবাদ জানতে পারি। ২০১৩ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর ওই শিক্ষিকাই একই বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্র রিফাত আহমদকে জুতা পেটা করে পত্রিকার শিরোনাম হয়েছিলেন। এ রকম নির্যাতনের কিছু ঘটনা পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হলেও অধিকাংশই থেকে যাচ্ছে আড়ালে। বিশেষজ্ঞদের মতে, নির্যাতনের কারণে শিক্ষার্থীরা স্কুলে যাওয়ার আগ্রহ হারাচ্ছে, নষ্ট হচ্ছে তাদের মানসিক ভারসাম্য। পড়ালেখা ছেড়ে তারা জড়িয়ে পড়ছে নানা ধরনের অপরাধে। জকিগঞ্জের কয়েকটি স্কুলের শিক্ষার্থীদের সঙ্গেও কথা বলে জানা যায়, পড়া না শেখা ও স্কুলে অনুপস্থিতিসহ অন্যান্য কারণে শিক্ষকরা প্রায়ই তাদের মারধর করেন। 'শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রছাত্রীদের শারীরিক ও মানসিক শাস্তি রহিত করা সংক্রান্ত নীতিমালা-২০১১'-তে বলা হয়েছে, শিক্ষার্থীদের চুলটানা, চিমটি দেওয়া, বেত্রাঘাত করা, কামড় দেওয়া, চক বা ডাস্টার ছুড়ে মারা, কান টানা, চেয়ার-টেবিলের নিচে মাথা দিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখা যাবে না। নীতিমালায় আরও বলা হয়, কোনো শিক্ষক বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্টরা এ ধরনের আচরণ করলে তা শাস্তিযোগ্য হিসেবে গণ্য হবে। এ অপরাধে সঙ্গে যে কোনো ধরনের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেলে তা ১৯৭৯ সালের সরকারি কর্মচারী আচরণ বিধিমালার পরিপন্থী হবে। প্রয়োজনে ফৌজদারি আইনেও অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আমরা মনে করি, উচ্চতর আদালতের নির্দেশনা এবং সংশ্লিষ্ট দুটি মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপন বাস্তবায়নে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উচিত শিক্ষার্থীদের শারীরিক শাস্তি প্রদানের মতো গর্হিত কাজ থেকে শিক্ষকদের বিরত রাখার প্রাতিষ্ঠানিক ও আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা। এছাড়া কলাকুটা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা আয়শা বেগম (নাসিমা)’র মতো শিক্ষার্থী নির্যাতনকারী শিক্ষকদের ক্ষেত্র বিশেষে দৃষ্ঠান্তমূলক শাস্তি প্রদান প্রয়োজন।
0 মন্তব্য:
Speak up your mind
Tell us what you're thinking... !