॥ আব্দুল হামিদ মানিক ॥
ঝালের পিঠা, ঝালের পিঠা কে রেঁধেছে কে? এক কামুড়ে একটুখানি আমায় এনে দে। কোথায় পাবো লঙ্কাবাটা কোথায় আতপ চাল, কর্ণফুলীর ব্যাঙ ডাকছে হাঁড়িতে আজকাল ‘এক ছিল টোনা আর এক ছিল টুনি। টোনা কহিল, টুনি পিঠা খাইব, পিঠা তৈরি কর, টুনি দিল লম্বা ফিরিস্তি। কহিল, চাউল আন, গুড় আন, কাঠ আন, আগুন আন.... তবে তো পিঠা করিব।’ টোনাটুনির শিশুতোষ এ-গল্পটিই বলে দেয়, আমাদের সমাজ জীবনে পিঠা ছিল বহুল পরিচিত ও সমাদৃত খাবার। বানরের পিঠা ভাগ এবং পিঠা নিয়ে গানের কথাও এ প্রসঙ্গে স্মরণ করা যায়। শীতকাল এলেই বাংলার বউ-ঝিরা পিঠাপুলি তৈরির তাড়না অনুভব করেন। পিঠা না খেলেও জীবন চলে। এরপরও গরিব-ধনী-নির্বিশেষে সকল পরিবারের মহিলারা পিঠেপুলির প্রতি আকর্ষণ অনুভব করেন; পরিবারের ছেলে মেয়েদের পিঠা খাওয়াতে তারা ব্যাকুল হয়ে পড়েন। এই তাগিদ, অন্তরের এই টান প্রমাণ করে যে পিঠা শুধু খাদ্য নয় আমাদের ঐতিহ্য। চাউল বা ভাত বাঙালির প্রধান খাদ্য। কিন্তু দেখা যায়, খাদ্য রসিক বাঙালি প্রাচীন কাল থেকে প্রধান খাদ্যের পরিপূরক, মুখরোচক আরও অনেক খাবার তৈরি করে আসছে। চিড়া, মুড়ি, নাড়ু, নানা ধরনের খই এবং রকমারি পিঠাপুলি এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য। তবে পিঠা এক্ষেত্রে সর্বাধিক গুরুত্বের দাবিদার। কারণ লোকজ এই শিল্প আবহমান বাংলার সামাজিকতার অপরিহার্য অঙ্গ হয়ে উঠেছিল। এ যুগে সামাজিকতার ক্ষেত্রে পিঠার প্রচলন কমে এসেছে। শুধু খাবার হিসেবে নয় বরং লোকজন ঐতিহ্য এবং নারী সমাজের শিল্প নৈপুণ্যের স্মারকরূপেও পিঠা বিবেচিত হয়। বাংলার নারী সমাজ অতীতে শিক্ষাদীক্ষায় অনগ্রসর ছিল সত্য। কিন্তু স্বীকার করতে হবে যে, চিরকাল এ দেশের নারী লোকজ শিল্পকর্মে অত্যন্ত নিপুণ। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বা পেশাগত প্রশিক্ষণ তাদের ছিল না। তবু তাদের দক্ষ হাতের শৈল্পিক কারুকাজ বিদেশের রুচিবান লোকদের সব সময় মুগ্ধ করেছে। নকশি কাঁথা, মসলিন, বাঁশ বেত শিল্প, মৃৎশিল্পসহ নানা রকম কুটির শিল্পের প্রধান কারিগর নারী। বলা হয় মসলিনের মিহি সুতা বিশেষ একটি বয়সের তরুণীদের হাতেই উন্নতমান লাভ করত। আবহমান বাংলার নারী সমাজের এই বিশেষ যোগ্যতা আজও রকমারি কারুকাজ ও স্বাদের পিঠা তৈরিতে টিকে আছে। পিঠার আকার আকৃতি ও স্বাদ ভিন্ন ভিন্ন। একই পিঠার নাম অঞ্চল ভেদে বিভিন্ন হয়। তবে মূল উপকরণ অভিন্ন। চালের গুঁড়ি, নারকেল, চিনি, গুড়, দুধ, ময়দা, সুজি, ডাল, চানা, তিল, আটা প্রভৃতি ব্যবহৃত হয়। খেজুর গাছের রস, তালের রস, তেলসহ কিছু কিছু মশলাও পিঠা তৈরিতে লাগে। বাংলাদেশে চাউলের অসংখ্য রকমভেদ আছে। পিঠা তৈরিতে আতপ চাউলের মানের দিকেও লক্ষ্য রাখা হয়। অতীতে ঘরেই ঢেঁকি বা উদুখলে (ঘাইল ছিয়া) চাউল থেকে গুঁড়ি তৈরি করা হতো। আজকাল অনেকেই রাইস মিলের আশ্রয় নেন। পিঠা তেলে ভাজা হতে পারে; ডুবো তেলে হতে পারে। পানি গরম করে ভাপ বা শুধু আগুনের উত্তাপে সেঁকেও কিছু কিছু পিঠা বানানো হয়। এই প্রস্ত্তত প্রণালির তারতম্যের সঙ্গে স্বাদেরও তারতম্য ঘটে। অতীতে সামাজিকতার অঙ্গ ছিল পিঠা। বউ-ঝিরা নাইওর যেতে আসতে তৈরি করে নিতেন পিঠা। মনোহর এবং রসনা তৃপ্তিকর পিঠা তৈরির কলাকৌশল ছিল আভিজাত্যের পরিচায়ক। কার বউর বাপের বাড়ি থেকে কত প্রকার পিঠা এসেছে, পাড়ার মহিলারা জড়ো হয়ে দেখতেন। চিহ্ন হিসেবে প্রতিবেশীদের ঘরে ঘরে তা পাঠানো হতো। আধুনিক কালের মতো বিস্কুট আর রেডিমেড মিষ্টির ছড়াছড়ি ছিল না। রসগোল্লা, নিমকি, জিলেপি, বুন্দিয়া, বাতাসা-জাতীয় মন্ডামিঠাই ছিল বিশেষ পেশাজীবীদের তৈরি। ঘরে তৈরি পিঠেপুলির মর্যাদা ছিল আলাদা। তাই কুটুমবাড়ি যেতে হলে পিঠা ছিল অপরিহার্য। শীতকালে নাতি নওশা নানার বাড়িতে আসবে, আর পিঠেপুলি খাবে না-এটি ছিল শরমের বিষয়। আজকাল সে রকম রেওয়াজ নেই। পিঠা বছরের সব সময়ই মহিলারা তৈরি করেন। তবে কিছু পিঠা মৌসুমি। শীতকাল বাংলাদেশে পিঠার মওসুম। অগ্রহায়ণ মাসে ঘরে ঘরে নতুন ধান ওঠে। নবান্নের আনন্দে তৈরি হয় হরেক রকম পিঠা। খেজুর গাছের রস জ্বাল দিয়ে ঘন করে গুড়ের মতো করা হয়। খেজুর রসেও বানানো হয় পিঠা। নিজে খেয়ে এবং অপরকে খাইয়ে বাংলার মা-ঝিরা লাভ করেন তৃপ্তি। ভোরে কনকনে শীতে কাঠের আগুনের চুলা ঘিরে বসে ভাই বোন। আগুনে সেঁকে অথবা গাইয়াড়ি থেকে নামিয়ে গরম গরম পিঠা বাটিতে তুলে দিচ্ছেন মা, বড়বোন অথবা দাদি, নানি। সে এক অপূর্ব আমেজ। চুলার কাঠের গনগনে অঙ্গার। রুটিপিঠা পাশে রাখতেই ফুলে উঠছে। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সেঁকে তুলে দেয়া হচ্ছে পাতে। সেকি স্বাদ! বাংলাদেশে হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ে পিঠার কদর ও প্রচলন আছে। পূজা পার্বণ, উৎসব অনুষ্ঠানে পিঠা তৈরির ধুম পড়ে। কবি সুফিয়া কামাল (১৯১১-১৯৯৯ খ্রি.)-এর স্মৃতি: পৌষ পার্বণে ‘পিঠা খেতে বসে / খুশিতে বিষম খেয়ে / আরো উল্লাস বাড়িয়াছে মনে / মায়ের বকুনি খেয়ে।’ হিন্দু সম্প্রদায়ে পৌষসংক্রান্তিতে পিঠেপুলি অনেকটা বাধ্যতামূলক। নানা স্বাদ ও জাতের মিষ্টি, নোনতা পিঠে তৈরি করা হয়। তিলের পিঠা এ সময় থাকবেই। পৌষসংক্রান্তিকে তিলের সংক্রান্তি ও বলা হয়। ঈদুল ফিতরের সময় মুসলমানদের খাবার তালিকায় ঘরে তৈরি পিঠা এখনো আছে। এ সময় ডুবো তেলে ভাজা চালের গুঁড়ির পিঠা ও নোনতা মশলা পিঠার এবং কুরবানির ঈদে রুটি পিঠার প্রধান্য থাকে। দেশে অসংখ্য প্রকারের পিঠে তৈরি হয়। এগুলোর নাম ও প্রস্তুতপ্রণালি বিচিত্র বর্ণিল। পিঠের গায়ে খেজুরকাঁটা বা অনুরূপ কাঠের ছিলা দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে নকশিও করা হয়, কারুকাজ করা হয়। কোনো কোনো পিঠার জন্য ছাঁচ আছে। কোনো পিঠাতে থাকে নকশা। পিঠার জন্য আছে বিশেষ ধরনের মৃৎপাত্র। মাটির হাঁড়ি, নিচ দিকে ছিদ্র আছে। সিলেট অঞ্চলে বলা হয় গাইয়াড়ি। ভাপা পিঠা বানাতে এটি ব্যবহৃত হয়। বাংলার পিঠেপুলির বিচিত্র স্বাদ, আকার ও প্রস্তুতপ্রণালি এত ব্যাপক ও বর্ণাঢ্য যে তা রীতিমতো গবেষণার বিষয়। বাজারে রেসিপি বা পাকপ্রণালির বইপুস্তকে কিছু কিছু পিঠার রন্ধনপ্রণালি আছে তবে শুধু পিঠার রেসিপি দুর্লভ। পিঠেপুলির নাম ও আকার বহু বিচিত্র। পরিচিত কয়েকটি পিঠার নাম : পুলি (অর্ধ চন্দ্রাকৃতি ভেতরে নারকেল গুড়), চিতই, বরা, পাতা, নারকেলি, মালফা, খেজুরি, ভাপা, পাফর, ম্যারা, মেড়া বা সিদ্ধ, তিল, রসপিঠা, পাটিসাপটা, ক্ষীরপিঠা, দুধকলি, খোলাজালি, চই, পব প্রভৃতি। এছাড়া বাহারি আরও অনেক নামের পিঠা আছে। এর মধ্যে অন্দরশা বা আন্দেশা অনথম, এলোকেশি, বিন্নিছড়া, বিন্নিসেকা, চন্দরাপাতা, চন্দ্রপুলি, দুধচিতই, দিলশাদ, ঝুরি, কালচেপড়া, সতিনের মোচড়, ফুলকুচি, গড়গড়ি, কড়কড়ি, ক্ষারমুরলি, পাকন, মাখনমালা, লাতকা, সন্ধ্যামনি, লবঙ্গ, খুশখেয়ালি, মৃগমোহিনী, রাঙাপুলি, ফুলনদাসা, নুনচিয়া, বাদশাভোগ, মইফুলা, ময়ুর পেখম, জামাইমুখ, কন্যামুখ প্রভৃতি। বিচিত্র এমন আরও অনেক নাম আছে। এগুলোর প্রস্তুতপ্রণালি এবং স্বাদের ভিন্নতাসহ পৃথকীকরণ বিশেষজ্ঞ ছাড়া অন্যের পক্ষে প্রায় অসম্ভব। একই পিঠা অঞ্চলভেদে একেক নামেও রয়েছে। তবে উপকরণ সর্বত্র সমান। উপকরণ হিসেবে ব্যবহৃত হয় আতপ চালের গুঁড়ো, ময়দা, গুড়, চিনি, দুধ, তেল, সরিষা, বাদাম, ডিম, ঘি, লবণ, কিশমিশ, গাজর, নারকেল, পেস্তাদানা, মুগডাল, বেকিং পাউডার, লেবুর রস, আদা, রসুন, গোশতের কিমা ইত্যাদি। বিভিন্ন উপকরণ পরিমাণ মতো মিশিয়ে তেলে ভেজে, সিদ্ধ করে, সেঁকে, পুড়িয়ে এবং ভাপে তৈরি হয় পিঠা। সিলেট অঞ্চলে বিশেষ করে মৌলভীবাজার, বড়লেখা, জকিগঞ্জ, সুনামগঞ্জ ও হবিগঞ্জের বানিয়াচংসহ কিছু কিছু এলাকায় শীতকালে বিশেষ ধরনের একটি পিঠা তৈরি হয়। এর নাম চোঙা পিঠা। বিন্নিধানের চাউল দিয়ে তৈরি এ পিঠার জন্য প্রয়োজন হয় মুলি প্রজাতির ছোট আকৃতির হালকা ছাল বিশিষ্ট এক প্রকার বাঁশ। আঞ্চলিক ভাষায় এটাকে চোঙার বাঁশ বলা হয়। এ বাঁশ সাইজ করে টুকরো করা হয়। চোঙের মধ্যে পরিমিত পানি ও চাউল রেখে মুখ বন্ধ করে দেয়া হয়। ঘরের বাইরে খোলা জায়গায় মাটি কেটে এক সঙ্গে অনেকগুলো চোঙা নালার মতো চুলা বানিয়ে কাঠোর আগুনে পুড়ে তৈরি হয় পিঠা। চোঙ নামিয়ে বাঁশের ছাল কলার ছোবড়ার মতো টেনে টেনে খসানোর পর সাদা ধবধবে ভাতের লাঠির মতো চোঙা পিঠা বেরিয়ে আসে। খেজুরি গুড়, মধু অথবা ভাজা মাছ সহযোগে আঠালো চাউলে তৈরি এ পিঠা খাওয়া হয়। আসলে এটি বিশেষ কায়দায় রান্না করা বিন্নি চাউলের ভাত। তবে আকৃতি ও স্বাদের জন্য এটিও পিঠা হিসেবে গণ্য হয়। সিলেটের এ পিঠার স্মৃতি এসেছে এ. কে আনামের একটি গানে- আরব যাইমু দুবাই যাইমু যাইমু গো ইরান দুই চোখ চাইয়া খুঁজে আমার সিলটর আসমান। আঙ্গুর কিশমিশ খাইয়া না পাইলাম আমার চোঙা পিঠার স্বাদ। ও আমার সিলটি...। এছাড়া নারকেল টুকরো ও গুড় দিয়ে সিদ্ধ পিঠা অথবা নারকেল কুচি ও গুঁড়ি মিশ্রিত কাঁঠাল পাতায় মোড়া ভাপের পিঠার স্বাদ কি ভোলা যায়? পিঠা তৈরিকে একটি শিল্পকর্ম বলা যায়। এর জন্য কোনো প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা হয়তো নেই। তারপরও এমন কোনো বাঙালি রমণী নেই যিনি কিছু কিছু পিঠা তৈরি করতে জানেন না। পিঠার কদর সমাদর ছিল, আজও আছে। সামাজিক জীবনে পিঠার প্রচলন পরিচিতির ফলেই দেখি কবিদের উপমায় পিঠা উঠে এসেছে কাব্যে। উৎসাভিসারী কবি আল মাহমুদের ‘পিঠার পেটের ভাগে ফুলে ওঠা তিলের মতন’ অথবা ‘পিঠার মতো হলুদমাখা চাঁদ / যেন নরম কলাপাতায় মোড়া’র মতো পঙক্তিগুলো স্মর্তব্য। লোকসাহিত্যে পিঠার বিশেষ স্থান আছে। ময়মনসিংহ গীতিকায় মলুয়ার পিত্রালয়ে বিনোদ যেসব পিঠা খেয়েছিল তার বিবরণ পাই- শুরুতে খাইল বেনুন, খাইল থোর ভাজা বরা পুলি পিঠা খাইল বিনোদ দুধের খিস্যায় ভরা। পাত পিঠা, বরা পিঠা, চিতই, চন্দ্র পুলি পোয়া চই খাইল কত রসে ঢলাঢলি। দুখে ভিজিয়ে রাখা, চিনি ছিটানো, গুড় দিয়ে তৈরি এবং নিতান্ত সাদামাটা শত শত প্রকার পিঠা ছিল অতীতে। শ্বশুরবাড়ি দামান্দ এলে আপ্যায়নের উপকরণ ছিল পিঠা। কিন্তু এখন পিঠার সেই জৌলুসে ভাটা পড়েছে। আজকাল শুধু মেলায় দেখা যায় রকমারি পিঠার সমাহার। শিশু একাডেমী, ঢাকাসহ শরহগুলোতে পিঠা প্রদর্শনীর আয়োজন করে। ঢাকায় পিঠার দোকান আছে। বিকিকিনি ভালোই হয় বলে জানা যায়। সিলেট শহরসহ বিভিন্ন শহরে শীতের রাতে ফুটপাতে দেখা যায় গরম গরম তৈরি করে ভাপা পিঠা বিক্রি হচ্ছে। একটি ভাপার দাম সিলেটে সাইজ ভেদে ৫ থেকে ১০ টাকা (জানুয়ারি ২০১৫)। পিঠার প্রচলন কমে গেছে দুটি কারণে। আধুনিক জীবনের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে প্রচলিত হয়েছে নতুন নতুন বাড়তি খাবার। বাজারে প্যাকেটকৃত রকমারি বিস্কিট, চিপ্স প্রভৃতি গ্রামেও হাত বাড়লেই পাওয়া যায়। তবে বড় কারণ অভাব অনটন।
লেখক : বিশিষ্ট কলামিষ্ট ও নির্বাহী সম্পাদক-দৈনিক সিলেটের ডাক
0 মন্তব্য:
Speak up your mind
Tell us what you're thinking... !