রহমত আলী হেলালী
“হক সাবর কথা মনে অইলে জানে কয় বাচ্চা কাচ্ছারে পুলিশ বানাইতাম। কিন্তু আতাউর, শুক্কুর আর এবাদুর কথা মনে অইলে লা-হাওলা পড়ি। উল্টা দোয়া করি দোস্ত দুশমন কেউরর বাচ্চা কাচ্ছারে আল্লায় পুলিশ বানাউক্কা না।” এভাবে পুলিশের প্রতি ঘৃণা প্রকাশ করলেন জকিগঞ্জের কামালপুর গ্রামের ইউসুফ আলী। অথচ এক সময় পুলিশের আইজিপি মরহুম এম.এ.হক (বাঘা হক) অত্যান্ত সুনামের সাথে পুলিশ বাহিনীতে চাকুরী করেছেন। তার মতো লোক পুলিশে চাকুরী করায় অনেকেই নিজের সন্তানকে পুলিশ বাহিনীতে দিতে আগ্রহী ছিলেন। তখন দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালনে পুলিশের ভূমিকাকে সম্মানের চোঁখে দেখতেন জকিগঞ্জবাসী। কিন্তু বর্তমান সময়ে জকিগঞ্জের মানুষের নিকট সেই সম্মানের আসনে পুলিশ তার অবস্থান ধরে রাখতে পারেনি। এর নেপথ্যে যে তিন জন পুলিশের ভূমিকা রয়েছে তারা হলেন সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের কোতোয়ালী থানার এক সময়ের ওসি আতাউর রহমান বাবুল, বিমানবন্দর ইমিগ্রেশনের এসআই আব্দুস শাকুর ও বিমানবন্দর থানার কনস্টেবল এবাদুর রহমান। জকিগঞ্জের মানুষ এখন এদের নাম শুনলে ছি: ছি: দেয়। যেখানে এলাকার সন্তান হিসেবে গৌরব প্রকাশের কথা সেখানে উল্টো ছি: ছি: দিচ্ছেন। জানা যায়, জকিগঞ্জ পৌর এলাকার নওয়াগ্রাম (শেখ পাড়া)’র মরহুম আজই মিয়ার বড় ছেলে আতাউর রহমান বাবুল সিলেট কোতোয়ালি থানার ওসি হিসেবে ২০১৩ সালের শুরুতে যোগদেন। পরবর্তীতে তার নানা অনিয়ম, দুর্নীতি ও ব্যর্থতার কারণে ২০১৩ সালের ৭ জুলাই বদলি করা হয় মৌলভীবাজার সদর থানায়। এরপর থেকে পুনরায় কোতোয়ালি থানায় ফিরতে তদবির শুরু করেন আতাউর রহমান। সিলেট জেলা ও মহানগর আওয়ামীলীগের কয়েকজন নেতার মাধ্যমে তদবির করে ওই বছরের ২৮ নভেম্বর আবারও কোতোয়ালিতে ফিরে আসেন। এরপর বেপরোয়া হয়ে ওঠেন ওসি আতাউর রহমান বাবুল। মাত্র কিছুদিনের মধ্যে নানা কারণে বিতর্কিত হয়ে উঠেন তিনি। শেষ পর্যন্ত ছাতক পৌর চেয়ারম্যান আবুল কালাম চৌধুরীর ভাই কামাল আহমেদ চৌধুরীকে থানায় আটকে অমানবিক নির্যাতনের ঘটনায় গত বছরের ২৪ জুলাই হাইকোর্টে একটি রিট আবেদনের প্রেক্ষিতে বিচারক সালমা মাসুদ চৌধুরী ও মোঃ হাবিবুল গনির সমন্বয়ে গঠিত একটি বেঞ্চ পুলিশের আইজিপি এবং সিলেটের পুলিশ কমিশনারকে ওসি আতাউর রহমানসহ অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে মামলা রুজুর নির্দেশ দেন। এ ঘটনায় শেষ পর্যন্ত তিনি আত্মরক্ষার্থে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। অভিযোগ রয়েছে ওসি আতাউর রহমান পুলিশের কনস্টেবল পদে চাকুরী নেন। এর পর তাকে আর পেছন থাকাতে হয়নি। বিভিন্ন সময় রাজনৈতিক দলের নেতাদের তোষামোদ করে বাগিয়ে নেন পদোন্নতি। রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায় থেকে হয়ে উঠেন ক্ষমতাধর। হয়ে উঠেন কোটি কোটি টাকার মালিক। তার বেপরোয়া দুর্নীতির লাগাম টানা সম্ভব হয় না পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের। ওসি আতাউর রহমানের অপকর্মের দায় বহন করতে হয় তার অধীনস্থদের। বিগত জোট সরকারের সময়ে ওসি আতাউর রহমান দুর্নীতি ও চাঁদাবাজির মাধ্যমে গড়ে তুলেন সম্পদের পাহাড়। নগরীর আল হামরা শপিংসিটিতে রয়েছে শাড়ীর দোকান। জকিগঞ্জে কোটি টাকা জায়গা-জমি ও দোকান পাট, নগরীর নয়া সড়কের ঠিকানা টাওয়ারে ছেলের নামে রয়েছে ফ্লাট বাড়ি ও ভোলাগঞ্জে রয়েছে পাথরের ব্যবসা। তার এহেন দুর্নীতি ও অপকর্মের ফলে দারুণ লজ্জিত হয়েছেন জকিগঞ্জবাসী। তবুও জকিগঞ্জবাসী বিষয়টিকে এড়িয়ে গিয়ে এলাকার সম্মান রক্ষার চেষ্ঠা করেন। কিন্তু পাশাপাশি সময়ে আপন ভাইকে খুন করে অমানবিক ও নিষ্টুরতার ইতিহাস সৃষ্ঠি করেন জকিগঞ্জের তিরাশী (দাসগ্রাম) গ্রামের মৃত মুজম্মিল আলীর পূত্র আব্দুস শাকুর। এ সময় তিনি সিলেট বিমানবন্দর ইমিগ্রেশন পুলিশের এসআই হিসেবে কর্মরত ছিলেন। জানা যায়, যে ভাইকে এসআই আব্দুস শাকুর নির্মমভাবে খুন করে সে ভাই নাকি নিজের টিফিনের ভাত প্রথমে তাকে খাওয়ানোর পর পরবর্তীতে ভাত থাকলে তিনি খেতেন। শুধু তাই নয়, এসআই শাকুর এ পর্যন্ত চলে আসার পেছনে যার শক্ত হাত ছিল তিনি হলেন তাঁরই নির্মম নির্যাতনে নিহত বড় ভাই আব্দুল করীম। অভিযোগ রয়েছে এই এসআই শাকুর নাকি তার আপন বড় ভাই শিক্ষক আব্দুল করিমকে অপর ভাই আব্দুর রহিমকে নিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে কবর দিয়েছে। পরবর্তীতে কবর থেকে লাশ তোলা হলে দেখা যায়, নিহত শিক্ষক আব্দুর করীমের বাম হাতের কুনুই ও কবজি ভাঙ্গা, পেটের বাম পাশে জখন, বাম পা ভাঙ্গা, ডান পায়ের হাটুর উপরে জখম, ডান পায়ের রগ কাটা, অন্ডকোষের কোন অস্তিত্ব নেই। পীঠের এক পাশে কাঁধের নীচে রক্তাক্ত জখম, ডান পায়ের রানের উল্টা দিকে আঘাতের দাগ, ডান পার নীচে উল্টা দিকে ছেচা জখম, মাথার বাম পাশ ও পিঠে জখম। যা দেখে সেদিন জকিগঞ্জের হাজারো মানুষ হতবাক হয়েছিল। কিন্তু এবার এসব কিছুকে হার মানিয়ে আরোও একধাপ বাড়িয়ে আলোচনায় চলে এসেছে জকিগঞ্জের বাল্লা গ্রামের মৃত আব্দুল খালিকের পুত্র এবাদুর রহমান। সে সিলেট বিমানবন্দর থানার পুলিশ কনস্টেবল হিসেবে কর্মরত ছিল। জানা যায়, গত ১০ মার্চ মঙ্গলবার মামার বাসায় যাওয়ার পথে সিলেট নগরীর রায়নগর থেকে অপহৃত হয় শাহমীর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্র আবু সাঈদ। অপহরণের পর তাকে নিয়ে রাখা হয় সিলেট বিমানবন্দর থানার পুলিশ কনস্টেবল এবাদুর রহমানের ঝর্ণারপাড় আবাসিক এলাকার ৩৭ নং বাসায়। সেখানে রেখে কনস্টেবল এবাদুর রহমানের একটি সিম ব্যবহার করে পাঁচ লক্ষ টাকা মুক্তিপন দাবী করা হয়। শেষ পর্যন্ত মোবাইল ট্র্যাকিংয়ের মাধ্যমে অপহরণের ৫ দিন পর স্কুল ছাত্র আবু সাঈদ (৯) এর গলিত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। গত ১৪ মার্চ শনিবার মধ্যরাতে পুলিশ কনস্টেবল এবাদুর রহমানের কুমারপাড়া ঝর্ণারপাড়স্থ বাসা থেকে লাশটি উদ্ধার করা হয়। নির্মম এ হত্যাকান্ডের বর্ণনা দিতে গিয়ে ওই পুলিশ কনস্টেবল আদালতকে জানায়, ‘সে সহ আরো তিনজন এ ঘটনার সাথে সম্পৃক্ত। এক সময় সাঈদের পরিবারের সাথে তার পরিবার একই বাসায় সাবলেট থাকতো। এই সুবাদে সাঈদের পরিবার ছিল পূর্ব পরিচিত। সাঈদকে অপহরনের পর তার বাসায় আনা হয়। কিন্তু, পূর্ব পরিচিত হওয়ায় তারা তাকে হত্যার পরিকল্পনা নেয়। এ অনুযায়ী অপহরণের পরদিন বুধবারই তাকে হত্যা করা হয়। এরপর লাশ গুম করতে ৭টি বস্তার ভেতরে তার লাশ ঢুকানো হয়।’ বিষয়টি এখন শুধু সিলেটে নয় পুরো বাংলাদেশে আলোচিত হয়ে উঠেছে। দেশের মানুষ একজন পুলিশের এহেন অমানবিক কর্মকান্ডে নির্বাক হয়ে পড়েছেন। একই সাথে জকিগঞ্জবাসী লজ্জায় মুখ দেখাতে পারছেন না। সিলেট শহরে বসবাসরত বেলাল আহমদ জানান, এ লজ্জা রাখি কোথায়। একজন নয়, দুইজন নয় এ পর্যন্ত তিনজন পুলিশ অমানবিকতার দৃষ্ঠান্ত তৈরী করলেন। নষ্ট করলেন জকিগঞ্জবাসীর ভাবমুর্তি। নন্দিত জকিগঞ্জকে করে তুলছেন চরম নিন্দিত। আমরা এমন পুলিশকে ধিক্কার জানাই।
0 মন্তব্য:
Speak up your mind
Tell us what you're thinking... !