জাহানারা চৌধুরী ঝর্ণা
জকিগঞ্জ থেকে ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী মার্বেল খেলা। এ উপজেলায় এক সময় মার্বেল না খেলে শিশু-কিশোররা ঘুমাতে পারতো না। মার্বেল খেলা শুধু জকিগঞ্জে নয় পুরো দেশের গ্রামাঞ্চলে ছিল এক সময় বেশ জনপ্রিয়। তখনকার সময়ের মার্বেল খেলার জনপ্রিয়তা নিয়ে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় কবিতা লিখেছেন। তিনি তাঁর কবিতায় মার্বেলকে ‘রয়্যাল গুলি’ উল্লেখ করেছেন। তিনি তাঁর ‘কেউ কথা রাখেনি’ কবিতায় লিখেছেন-“একটা রয়্যাল গুলি কিনতে পারিনি কখনো / লাঠি লজেন্স দেখিয়ে দেখিয়ে চুষেছে / লস্কর বাড়ির ছেলেরা / ভিখারীর মতো চৌধুরীদের গেটে দাঁড়িয়ে দেখেছি”। দারিদ্র্যের কশাঘাতে কৈশোরে দুর্বার আকর্ষণের এই মার্বেল কেনার সামর্থ্য না থাকা কতটা কষ্টের, তারই বর্ননা সুনীলের এই কবিতার পংক্তিতে দৃশ্যমান। জানা যায়, আমাদের দেশে গ্রামাঞ্চলে মার্বেল খেলাটা জমে উঠতো মূলত বিশেষ কোন উৎসবে-পার্বণে। তবে এখন আর তেমনভাবে দেখা যায় না। মার্বেলের স্থান দখল করেছে মুঠোফোনে-কম্পিউটারে কার্টুন আর গেমসে। এখন গাঁয়ের পায়ে চলার সরু পথ, বাড়ির পাশের আম-কাঁঠালের বাগানের ভেতর ফাঁকা জায়গাসহ সামান্য খোলামেলা জায়গাতে শিশু-কিশোরদের মর্বেল খেলা দেখা যায় না। মার্বেল খেলার ধরণ সম্পর্কে জানা যায়, ছেলেরা নির্দিষ্ট একটা ছকের বাইরে একটা গর্ত করে। ছকের বাইরে বসে প্রত্যেকে একটি করে মার্বেল ওই গর্তে ফেলার চেষ্টা করে। যার মার্বেল গর্তে পড়ে বা সবচেয়ে কাছে যায় সে প্রথম দান পায়। যে প্রথম দান পায় সবাই তার হাতে ২/৩/৪টি করে মার্বেল জমা দেয়। সে মার্বেলগুলো ছকের বাইরে বসে সামনের দিকে ওই গর্তের আশপাশে আলতো করে ছড়িয়ে দেয়। এরপর অন্য খেলোয়াড়রা একটা নির্দিষ্ট মার্বেলকে বলে ‘বাদ’। অর্থাৎ ওই মার্বেল ছাড়া বাকি যে কোন একটি মার্বেলকে অন্য একটি মার্বেল ছেড়ে দিয়ে স্পর্শ করতে হবে। যদি এমনটা পারে তাহলে ওই দান সে জিতে যায়। আর না পারলে পরবর্তী জন একইভাবে খেলার সুযোগ পায়। তবে ‘বাদ’ দেয়া মার্বেল কিংবা অন্য একাধিক মার্বেলকে ছুড়ে দেয়া মার্বেল স্পর্শ করলে ওই খেলোয়াড়কে ফাইন দিতে হয়। আর দান জেতার জন্য পরবর্তী খেলোয়াড় ফাইন হওয়া মার্বেলসহ সেগুলো ছড়িয়ে দিয়ে খেলতে থাকে। যে কেউ দান জিতলে আবার পুনরায় খেলা শুরু হয়। এভাবেই চলতে থাকে যতক্ষণ না প্রতিপক্ষ আত্মসমর্পণ করে কিংবা তার কাছের মার্বেল শেষ না হয়ে যায়। জকিগঞ্জ উপজেলার গ্রাম গঞ্জে এভাবেই মার্বেল খেলা হয়ে থাকতো। জকিগঞ্জে মাত্র একযুগ পূর্বে গ্রামের রাখাল বালক থেকে শুরু করে স্কুল পড়ুয়া শিশু-কিশোর-কিশোরীদের মধ্যেও দেখা যেত মার্বেল আসক্তি। শিক্ষার্থীদের দেখা যেত স্কুল ব্যাগের ভেতর কিংবা হাফপ্যান্টের পকেটে মার্বেল নিয়ে ঘুরছে। আর এ জন্য অভিভাবক কিংবা শিক্ষকের হাতে কানমলা খায়নি এমন কিশোর এক সময় খুঁজে পাওয়া মুশকিলই ছিল। স্কুলে টিফিনের ফাঁকে সামান্য দূরে শিক্ষকদের চোঁখের আড়ালে গিয়েও শিশু-কিশোররা মেতে উঠত মার্বেল খেলায়। কিন্তু আজ আর সেই জনপ্রিয় মার্বেল খেলার দৃশ্য চোঁখে পড়েনা। অথচ মার্বেল খেলা নিয়ে এমন নানা স্মৃতি এখনও অনেকের মাঝে বিদ্যমান। হয়তো আর কয়েক দশক পর স্মৃতিমন্থনের মতো কাউকে খুঁজে পাওয়াও কঠিন হবে বলে মনে করেন জকিগঞ্জের সচেতন মহল।
0 মন্তব্য:
Speak up your mind
Tell us what you're thinking... !