
॥ রহমত আলী হেলালী ॥
আজকের বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সূচনা হয়েছিল ভাষা আন্দোলনের হাত ধরেই। তাই ভাষা আন্দোলনকে স্বাধীন বাংলাদেশের ভিত্তি বলা হয়ে থাকে। আমাদের মহান ভাষা আন্দোলনে সিলেটবাসীর ভূমিকা ছিলো অবিস্মরণীয়। সিলেটের মাটিতে আরবী, উর্দু, ফার্সী ভাষা ও সাহিত্য চর্চায় বিশেষ খ্যাতি থাকলেও মাতৃভাষার প্রশ্নে ও দাবীতে সিলেটবাসীদেরকেও খুঁজে পাওয়া যায় আন্দোলনের প্রথম সারিতেই। ১৯৪৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তমদ্দুন মজলিস “পাকিস্থানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু” নামক একটি গ্রন্থ প্রকাশ করে। একই বছরের ৯ই নভেম্বর সিলেটের কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদের সভায় মুসলিম চৌধুরী বাংলার পক্ষে প্রবন্ধ পাঠ করেন। সংসদ অত্যান্ত গুরুত্বের সাথে মুসলিম চৌধুরীর প্রবন্ধটি গ্রহণ করে। সংসদের সাধারণ সম্পাদক ও আল-ইসলাহ সম্পাদক মুহাম্মদ নুরুল হকও সক্রিয় হয়ে উঠেন বাংলা ভাষার দাবীতে। সংসদের সাথে সংশ্লিষ্ট বুদ্ধিজীবিদের নিয়ে ১৯৪৭ সালের ৩০শে নভেম্বর সিলেট আলীয়া মাদ্রাসা হলে আয়োজন করা হয় সুধী সমাবেশের। এই সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন জকিগঞ্জবাসীর গৌরবের সন্তান খ্যাতনামা রস সাহিত্যিক ও অনুবাদক মতিন উদ্দীন আহমদ। শুধু তাই নয় তিনি কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদের সভায়ও সভাপতিত্ব করেন। কিন্তু এই মহান ব্যক্তির সাথে জকিগঞ্জের নতুন প্রজন্মের পরিচয় নেই। অথচ যার কথা না লিখলে সিলেটের ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস অসম্পূর্ণ থেকে যায়। বলতে গেলে তিনি ছিলেন সিলেটের ভাষা আন্দোলনের প্রথম সংগঠক। যিনি তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের উচ্চ পদে চাকুরীতে থাকাকালীন সময়ে বাংলা ভাষার দাবীতে সমাবেশ করেন। তার উৎসাহ আর অনুপ্রেরণায় তখন ভাষা আন্দোলনে এগিয়ে এসেছিলেন অনেকে। ভাষা আন্দোলনের এই বীর সেনানীর গ্রামের বাড়ি ছিল জকিগঞ্জ উপজেলার কাজলসার ইউনিয়নের আটগ্রাম সাজিদ রাজার বাড়িতে। তার পিতা ছিলেন গিয়াস উদ্দিন চৌধুরী ও মাতা মিছবাহুন নেসা। ১৯০০ সালের ১০ জুন জন্ম নেয়া এই কিংবদন্তি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শুরু করেন নিজ গ্রামে। পরবর্তীতে তিনি করিমগঞ্জ হাইস্কুল, সিলেট এমসি কলেজ, কলকাতা রিপন কলেজ ও রিপন ল’ কলেজ থেকে লেখা পড়া করে বিএল পাশ করেন। ছাত্র জীবনে তিনি এমসি কলেজ ছাত্র সংসদ নির্বাচনে সাহিত্য সম্পাদক পদে বিপূল ভোটে নির্বাচিত হয়েছিলেন। ভাষা সৈনিক মতিন উদদীন আহমদ কর্মজীবন আইন পেশা দিয়ে শুরু করেন। কিন্তু অল্প দিনের মধ্যে আসাম প্রাদেশিক সিভিল সার্ভিসে মনোনয়ন পেয়ে আইন পেশা ছেড়ে দেন। ১৯২৭ সালের ৪ মে গোয়াইনঘাটে সাব ডেপুটি কালেক্টর পদে যোগদান করেন। দীর্ঘ ২০ বছর কোন পদোন্নতি ছাড়াই আসামের বিভিন্ন অঞ্চলে কাজ করেন। দেশ বিভাগকালীন সময়ে পাকিস্তান সিনিয়র সিভিল সার্ভিসে যোগ দেন। ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট সিলেটের এডিএম (এসিসট্যান্ট ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট) নিযুক্ত হন। এডিএম হিসেবে দায়িত্ব পালনকালীন ১৯৪৯ থেকে ১৯৫২ সাল পর্যন্ত সিলেট মিউনিসিপ্যালিটির (বর্তমান সিটি করপোরেশন) সরকার মনোনীত প্রশাসক ছিলেন। পরবর্তীতে পদোন্নতি পেয়ে পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন অঞ্চলে কাজ করেন। ১৯৫৮ সালের ১ জানুয়ারী রাজস্ব বোর্ডের স্পেশাল অফিসার পদে কর্মরত অবস্থায় সরকারী চাকুরী থেকে অবসর গ্রহণ করেন। ডিআইটি গঠিত হলে সরকার তাকে উপদেষ্ঠা নিয়োগ করে। ইতিমধ্যে স্বল্প সময়ের জন্য নারায়ণগঞ্জ পৌরসভার প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তীতে ঢাকায় আমেরিকান প্রতিষ্ঠান ফ্রাস্কলিন পাবলিকেশনের সম্পাদকীয় বিভাগে কাজ করেন। পিতার সিদ্ধান্তে ছাত্র জীবনেই ১৯২৪ সালের অক্টোবর মাসে তিনি জাতি কন্যা লুৎফুন্নেছা খাতুনের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। দীর্ঘ দাম্পত্য জীবনে তিনি এক পুত্র ও নয় কন্যা সন্তানের জনক হয়েছিলেন। ১৯৭০ সালের ২৮ জুলাই স্ত্রী ইন্তেকাল করলে মতিন উদদীন আহমদের মনোবল অনেকটা ভেঙ্গে পড়ে। পরবর্তীতে তিনি ১৯৮০ সালের ৩ জুলাই ইন্তেকাল করেন। মরহুম মতিন উদদীন আহমদ সাহিত্য ক্ষেত্রে ছিলেন কয়েক ধাপ এগিয়ে। তিনি বিভিন্ন বিষয়ের উপর অর্ধশতাধিক বই লিখেছেন। এই মহান ব্যক্তির নামে সিলেট নগরীতে রয়েছে একটি সমৃদ্ধ জাদুঘর। সিলেট নগরীর জিন্দাবাজারস্থ শুকরিয়া মার্কেটের উপরে এই জাদুঘরটি দীর্ঘদিন থেকে চলে আসলেও সম্প্রতি তা কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদে স্থানান্তর করা হয়েছে বলে জানা যায়। জকিগঞ্জের এই কিংবদন্তি পুরুষের জীবন পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, সিলেটের ভাষা আন্দোলনে তিনি-ই ছিলেন অন্যতম উদ্যোগক্তা ও সংগঠক। তাই সিলেটের ভাষা আন্দোলন ও জকিগঞ্জে মতিন উদদীন আহমদ একই সূত্রে গাঁথা। তথ্য সূত্র : জকিগঞ্জ মনীষা।
লেখক : প্রধান সম্পাদক সাপ্তাহিক জকিগঞ্জ সংবাদ
0 মন্তব্য:
Speak up your mind
Tell us what you're thinking... !