জাহানারা চৌধুরী ঝর্ণা
জকিগঞ্জের শত শত বছরের জনপ্রিয় সংস্কৃতি নৌকা বাইচ প্রতিযোগীতা কালের আর্বতে হারিয়ে যেতে বসেছে। কালের ধারাবাহিক অযতেœর ফলে এ উপজেলার নদী, খাল ভরাট ও দখল হয়ে যাওয়ায় বর্ষা মৌসুমেও ঠিকমত পানি থাকে না জকিগঞ্জে। বর্তমান বর্ষার ভরা মৌসুমেও পানি শুন্য জকিগঞ্জ খাল-বিল ও নদী-নালা। প্রয়োজনীয় পৃষ্ঠপোষকতা এবং নদী ও খালে পানি না থাকায় হারাতে বসেছে যুগ যুগ ধরে এ অঞ্চলের মানুষের আনন্দ দিয়ে আসা মনোমুগ্ধকর জনপ্রিয় ঐতিহ্যবাহী নৌকা বাইচ প্রতিযোগীতা। রহিমপুরী খাল, সেনাপতির খাল, মছকন্দর খাল, পীরের খাল, শিকার মাহমুদ খাল, নাতের খাল, মাদার খাল, দাসের খাল, কাপনা খাল, তেলী খাল, পীরনগর খাল, বেরশ্রী গাং, জায়গীরদারী খাল, বরজান খাল, বিয়াবাইল খাল, মরইর খাল, মুরাদ খাল, সুনাম খাল, বাবুর খাল, শিবের খাল, ছাগলী খাল, কুদালী খাল, হাতিদারা খাল, কুনাইর খাল কুল গাং ও তাল গাং হয়ে সুরমা এবং কুশিয়ারা নদীতে পড়েছে। বর্ষা মৌসুমে এ সকল খাল-নালা দিয়ে সুরমা ও কুশিয়ারা নদী থেকে পানি এসে মাঠ ভরাট হয়ে যেত। তখন উপজেলা বৃহৎ দু’টি হাওর বালাই ও মইলাটকে দেখা যেত এক মিনি সাগর। তখন জকিগঞ্জের বেশ কয়েকটি এলাকার মানুষ নৌকা ছাড়া চলাচল করতে পারত না। তখন মানুষের জীবন জীবিকা এবং পারাপার নৌকা নির্ভর হয়ে যেত। ফলে জকিগঞ্জের ভাটি অঞ্চলের শুধু পুরুষ নয় নারী ও শিশুরাও নৌকা চালাতে সমান পারদর্শী ছিল। দূর্দান্ত সাহসী ভাটি অঞ্চলের মানুষেরা বর্ষার চলন্ত ঢেউ কে মাড়িয়ে নৌকা চালাতো। ব্যবসা, বিনোদন এবং পারিবারিক কাজে ব্যবহারের জন্য বিভিন্ন আকৃতি ও নির্মান শৈলীর নৌকা তৈরি করতেন মিস্ত্রীরা। নৌকা তৈরি ও মেরামতের জন্য কাঠ মিস্ত্রীদের নিয়ে গড়ে উঠেছিল একটি শিল্প। সে সময় বন্যায় এ অঞ্চলের মানুষের জীবন জীবিকায় মারাতœক বাধগ্রস্থ করতো। মধ্যবিত্ত ও নিম্ন আয়ের পরিবারে নেমে আসতো অভাব অনটন। শত অভাব অনটনের মাঝেও এ জনপদের মানুষকে দমিয়ে রাখা যায়নি। বর্ষার কয়েক মাসই এ জনপদের পাড়া পাড়ায় রাতে আসর বসতো কবিয়ালি, জারিÑসারি, বেহুলা সুন্দরী ও যাত্রাপালার। আর দিনে চলতো নৌকা বাইচ। এ জনপদে কবে, কখন থেকে এ নৌকা বাইচ প্রতিযোগিতার প্রচলন শুরু হয়েছে এর কোন সঠিক ইতিহাস পাওয়া যায়নি। স্থানীয় সমাজ সেবক, জনপ্রতিনিধি, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব এবং সাংস্কৃতিক কর্মীদের যৌথ আয়োজনে বিভিন্ন স্থানে আয়োজন করা হতো এ মনোমুগ্ধকর নৌকা বাইচ প্রতিযোগিতা। মানুষকে আনন্দ দান এবং নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমান করতেই এ নৌকা বাইচ এর আসল উদ্দেশ্যে ছিল। নির্মান শৈলীর এবং বিজয়ী নৌকার মালিক বা সমর্থক হওয়া গর্বের বিষয় হওয়ায় শত প্রতিবন্ধকতার মাঝেও যুগ যুগ ধরে জকিগঞ্জ উপজেলার প্রত্যান্ত অঞ্চলে নৌকা বাইচ প্রতিযোগীতার আয়োজন করা হতো। একই দিনে একসঙ্গে এ নৌকা বাইচ না হয়ে পূর্ব নির্ধারিত সময় ও স্থানে নৌকা বাইচ অনুষ্ঠিত হতো। হাজার হাজার নারীÑপুরুষ আনন্দমুখর পরিবেশে মনোমুদ্ধকর এ বাইচ প্রতিযোগীতা উপভোগ করতো। এসব বাইচ নৌকা পানিতে প্রথম ভাসানোর দিন কিছু আনুষ্ঠনিকতা ছিল। কোন শুভ দিন দেখে নৌকার আগ গুলইয়ে সিদুরের ফোটা ও ধান দূর্বা দিয়ে বরণ করে নেওয়া হতো। দুধ ঢেলে ভোগ দেওয়া হতো। তবে এ কাজগুলো পুরুষরা না করে নৌকায় মাঝিÑমাল্লা, বৌÑঝি এবং প্রতিবেশিরাই করে থাকতো। নৌকার বিজয়ী হওয়ার মাঝেই এলাকার গৌরব ও মান ইজ্জত নিহিত ছিল। তাই এ কাজ গুলো সবাই মনযোগ সহকারেই করতো। বাঁজনার তালে তালে নৌকার দু’পাশে বসা বাইছালরা সামনে এবং পিছনের দিকে হেলে সমান তালে বৈঠা উঠানো ও নামানোতে এক মনোমুগ্ধকর দৃশ্যের অবতারনা হতো। নৌকার পিছনে শুধু শক্ত মাঝি হাল ধরে থাকতো। নৌকার মধ্যেই থাকতো টিকারা বাধক, কাঁসা বাধক এবং পাল গোড়ায় থাকতো একজন বয়াতী। সঙ্গে থাকতো কয়েকজন সারন্দার গায়ক। বাইচ শুরু হলে বাইছাল নৌকার বাইছালদের দু দিকে বাংলার চিরচেনা পানি ছিটিয়ে উচ্চস্বরে আওয়াজ দিয়ে উৎসাহ দিত। দমফাটানো উত্তেজনাকর সে দৃশ্য যেন আবহমান বাংলার চিরচেনা হাজার বছরের কৃষ্টি কালচার ছিল। দর্শকদের মাতিয়ে তোলার জন্য ছোট নৌকায় সং সাজানো হতো। সুরমা নদীর আটগ্রাম বাজার ঘাটে সবচেয়ে বড় বাইচ অনুষ্ঠিত হয়। নদীর দু,তীরে হাজার হাজার দর্শক এবং পাড়ে জায়গা না হওয়ায় স্যালো ও ডিঙ্গী নৌকা নদীতে ভাসিয়ে বাইচ উপভোগ করতেন অনেকে। পুরুষ দর্শকদের মত নারীদেরও উপস্থিতি ছিল প্রায় সমান সমান। যে কয়েক দিন বাইচ হতো ততদিন ঐ এলাকায় এক উৎসব শুরু হতো সবার মাঝে। দূর দুরান্ত থেকে আতœীয় স্বজনরা উপস্থিত হতো এ নৌকা বাইচ উপভোগ করার জন্য। দোকানিরা পসরা সাজিয়ে বসতো বাদাম, চানাচুর, জিলাপী, আইসক্রীমসহ বিভিন্ন কিছু নিয়ে। বিভিন্ন এলাকা থেকে শতাধিক বাইচ নৌকা অংশ নিত এই সব প্রতিযোগীতায়। সময়ের ধারাবাহিক অযতেœর ফলে জকিগঞ্জের নদÑনদী ও খালে পলি জমে গেছে। তৈরি হয়েছে অপরিকল্পিত রাস্তাÑঘাট, ব্রীজÑকালভার্ট। তাই জকিগঞ্জে খাল বিলে এখন নৌকা বাইচ প্রতিযোগীতা অকল্পনীয়। তবে গত বছর পর্যন্ত জকিগঞ্জের সুরমা নদীর আটগ্রাম বাজার ঘাটে নৌকা বাইচ প্রতিযোগীতা অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, এবার আর সেই নৌকা বাইচ প্রতিযোগীতার কোন আলামত পরিলক্ষিত হচ্ছে না। বলা যায়, গত কয়েক বছর ধরে এ অঞ্চলের কিছু সমাজ সেবক ও সাংস্কৃতিক কর্মী হাজার বছরের ঐতিহ্য নৌকা বাইচ প্রতিযোগীতা অনেকটা খুড়িয়ে খুড়িয়ে চালিয়ে আসলেও এখন তা সম্পূর্ণরূপে হারিয়ে যেতে বসেছে। বিলীন হতে বসেছে অত্যান্ত জনপ্রিয় মনমাতানো নৌকা বাইচ প্রতিযোগীতা।
0 মন্তব্য:
Speak up your mind
Tell us what you're thinking... !