জাহানারা চৌধুরী ঝর্ণা
জকিগঞ্জ উপজেলা বাশ ও বেতের জন্য বিখ্যাত ছিল। এ উপজেলার প্রতিটি এলাকায় প্রচুর বাশ ও বেত পাওয়া যেতো। স্থানীয় একটি প্রবাদ আছে-“মাছ, বাশ, সুপারী/ জকিগঞ্জের বেটাগিরী”। তাই এই উপজেলায় এক সময় বাশ ও বেত শিল্পের জয়জয়কার অবস্থা ছিল। কিন্তু আজ কালের গর্ভে এবং আধুনিকতার ছোঁয়ায় পাল্টে দিয়েছে সর্বত্র গ্রাম বাংলার চালচিত্র। দিন দিন বাঁশ ও বেত শিল্পের কদর কমে যাচ্ছে, পাশাপাশি চরম দুর্দিন নেমে এসেছে শিল্পটির সাথে জড়িত কারিগরদের জীবনে। প্লাস্টিক সামগ্রী জিনিসপত্র ব্যবহারে এ শিল্প ধংসের কারণ। জানা যায়, জকিগঞ্জ উপজেলা নয় এক সময় বাংলার শহর-নগরে বাঁশ ও বেত দিয়ে তৈরি নানা প্রকার শিল্প সামগ্রীর বেশ কদর ছিল। বাঁশ ও বেত দিয়ে বিশেষভাবে প্রস্তুতকৃত সামগ্রীর মধ্যে-ঝুড়ি, ডালা, কুলা, চাঙ্গারী, মুড়া, ঢুষি, হাতপাখা, চালোন, টোকা, বাঁশি, গোলা, ডোলা, আউড়ি, চাঁচ, ধামা, পাতি, চেয়ার, টেবিল ও বই রাখার তাক সহ বিভিন্ন প্রকার শিল্প সামগ্রী ব্যবহার করা হত। ধনী-গরীবসহ সকল পেশার মানুষ কম বেশি অনায়াসেই বাঁশ ও বেত জাত সামগ্রী ব্যবহার করত। পাশাপাশি এ শিল্পের সাথে জড়িত মানুষ তাদের জীবন-জীবিকা চালাতো অনেক সুন্দরভাবে। কিন্তু বর্তমানে সময়ের ব্যবধানে আধুনিক ষ্টীল, প্লাষ্টিকের তৈরি নিত্য নতুন ডিজাইনের বিভিন্ন সামগ্রী খুব সহজে অনেক কম মূল্যে হাতের নাগালে টেকসই হওয়ার কারণে এবং প্রচুর পরিমানে এ সামগ্রী ব্যবহারের কারণে বাঁশ ও বেত দিয়ে প্রন্তুতকৃত শিল্প সামগ্রী সকলের কাছে গ্রহণযোগ্যতা হারিয়ে ফেলছে বলে অনেকেই জানায়। সাথে সাথে এ শিল্পের কারিগররা সীমাহীন কষ্টের মধ্যে থেকেও এ ঐতিহ্য এখনো ধরে রেখেছে। তবে এলাকায় এখন তেমন ঝোপ-ঝাড় না থাকায় বেত অনেকাংশে পাওয়া যায় না। এছাড়া শিল্পের সামগ্রী জোগাড় করতে অনেক সময় ও অর্থ লেগে যায়। এগুলো তৈরি করতে এ পেশার লোকদের কেউ ঋন দেয় না। ফলে অনেকে পেশা বদল করে বিভিন্ন ব্যবসা-বাণিজ্যে জড়িত হয়েছে। কোন কোন এলাকায় এখনও গৃহস্থলির কাজের পাশাপাশি মহিলারা বাশ-বেতের তৈরী জিনিষ বানাতে দেখা যায়। সে কারণে সকল প্রতিকুলতার সত্ত্বেও আজও অন্য কাজে পুরুষদের পাশাপাশি মহিলারাও ঐতিহ্যবাহী এ শিল্পের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। সাথে সাথে মহিলারা পরিবারের বাড়তি আয় হিসেবে প্রতিদিন কাজ করে প্রায় পুরুষের কাজের পাশে বাড়তি আয় ১০০-১২০ টাকা যোগ হয়। সর্বপরি বাঁশ ও বেত শিল্পের সাথে সংশ্লিষ্ট কারিগর ও সর্ব মহলের ধারণা, আধুনিক সরঞ্জমের ব্যবহার কমিয়ে সরকারি, বে-সরকারিভাবে কারিগরদের বিভিন্ন সাহায্য সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে বাঁশ ও বেত শিল্প অর্থাৎ আমাদের দেশের হস্তশিল্প টিকিয়ে রাখা এবং সংশ্লিষ্ট কারিগরদের স্বাভাবিক জীবন-যাপনে গুরত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা সম্ভব। এব্যাপারে জকিগঞ্জের বিভিন্ন হাট বাজারে এ সামগ্রী বিক্রেতা তারী লাল বিশ্বাস জানান, ৪০-৪৫ বছর যাবৎ এ ব্যবসা করছি, কিন্তু আগের মতো এখন আর এ ব্যবসায় জৌলুস নেই। বাঁশ ও বেতের দু¯প্রাপ্যতার কারণে এ ব্যবসার ঐহিত্য ধরে রাখা সম্ভব হচ্ছে না। আরো এক বাঁশ ও বেতশিল্পী জানান, গ্রামাঞ্চলে যে বাঁশ পাওয়া যায় তা চড়া মূল্যে কিনতে হয়। আর বেত নেই বললেই চলে। জিনিসপত্র তৈরি করে সঠিক মজুরি পাওয়া দায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাজারে বাঁশ বেতের সামগ্রীর বিকল্প এখন বাহারি প্লাস্টিক সামগ্রী বিক্রি হচ্ছে। তার পরও সৌখিনদের কাছে বাঁশ ও বেতের সামগ্রীর বেশ কদর রয়েছে। বাঁশ ঝাড় উজাড় হওয়ার নেপথ্যে অন্যতম কারণ, বাঁশের মুড়া তুলে ব্যাপকভাবে পোড়ানোর কারণে, পরিচর্যার অভাব ও প্রয়োজনীয় পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে বাঁশের তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। সংকটময় হয়ে উঠছে পরিবেশ। সব মিলিয়ে বাঁশ ও বেতের অভাবে এ শিল্প আজ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে।
0 মন্তব্য:
Speak up your mind
Tell us what you're thinking... !