জাহানারা চৌধুরী ঝর্ণা
জকিগঞ্জের গ্রাম-গঞ্জের মানুষের নিকট এক সময় হুক্কা ছিল অতি জনপ্রিয়। তখন উপজেলার প্রায় প্রতিটি ঘরে ঘরে শোভা পেত হুক্কা। কিন্তু সময়ের পালা বদলের সাথে সাথে গ্রাম বাংলার প্রাচীন ঐতিহ্য হুক্কা হারিয়ে গেছে । হুক্কা আমাদের কাছে শুধু হারানো ঐতিহ্য ছাড়া আর কিছুই নয়। তখন গ্রামের গরিব-ধনী প্রায় প্রতিটি পরিবারে হুক্কা ছিল আভিজাত্যের প্রতীক। কৃষকেরা সারাদিন মাঠে হাড়ভাঙা পরিশ্রমের পর আরাম করে বসে হুক্কা টানতেন আর ভুলে যেতেন সারাদিনের ক্লান্তি। দিনভর অক্লান্ত কাটুনির পর হুক্কায় একটা টান যেন শরীর জুড়ে এনে দিত পরম আনন্দের তৃপ্তি। ধনী গরীব প্রায় সব বয়সের পুরুষ হুক্কা টানত। মাঝে মাঝে অনেক মহিলাও সখ করে হুক্কায় টান দিতেন। হুক্কার টানার প্রধান উপকরণ হচ্ছে তামাক। তামাক পাতা ছোট ছোট করে কেটে তাতে চিটাগুড় মিশিয়ে তৈরি করা হত তামুক। একধরনের নেশাজড়ানো সুবাস বের হত এই তামুক থেকে। তামুকের ক্ষতিকারক নিকোটিনের বড় একটি অংশ হুক্কার পানিতে মিশে যেত। যার ফলে এক ধরনের নিকোটিন মুক্ত ধুয়া পান করত মানুষ। উপজেলার প্রায় প্রতিটি হাট-বাজারে বিক্রি হত এই তামাক। কলকেতে সাজানো তামাক পুড়তে শিম লতা পুড়িয়ে তৈরি এক ধরনের টিক্কা ব্যবহার করা হত। শিম লতা শুকিয়ে আগুনে পুড়িয়ে ভাতের মাড় মিশিয়ে বানানো হত টিক্কা। মধ্যবিত্ত এবং অভিজাত পরিবারে হুকার কলকেতে টিক্কা ব্যবহার করা হত। হুক্কার অন্যতম উপাদান হচ্ছে দু’ছিদ্র বিশিষ্ট পিতল অথবা মাটির তৈরি বিশেষ আকারের পাত্র। একটি ছিদ্র থাকে পাত্রের উপরে অন্যটি পাশে। উপরের ছিদ্রটি দিয়ে পাত্রে পানি ঢোকানো ও ফেলে দেয়া হত। পাশের ছিদ্র দিয়ে হুক্কার কলকে বসাতে তামা বা কাঠের কারুকার্য খচিত ফাঁপা নল বসানো হয়। ব্যক্তির রুচি এবং সামাজিক অবস্থান অনুযায়ী হুঁকোর নলের কাঠ বা বাঁশে কারুকাজ করা হয়। সাধারণত বিলুপ্ত জমিদার বা মহাজন প্রজাতির উচ্চ বংশীয়দের মর্যাদা অনুযায়ী পিতল, রূপা এমনকি স্বর্ণের কারুকার্যময় হুঁকো তৈরি করা হতো। এগুলোর রাবারের নল ক্ষেত্র বিশেষে ২০ গজ পর্যন্ত লম্বা হতো। জমিদার সাহেব দামি আরাম চেয়ারে বসে সুগন্দি তামাকের স্বাদ নিতেন চোখবুজে। খাস খানসামা হুঁকোর তামাক সাজা, সুগন্দি টিকিয়া জ্বালানোসহ প্রয়োজনে হুঁকোটি বহন করতেন। লম্বা রবারের নল স্বাভাবিক অবস্থায় সাপের মত হুক্কার সাথে পেঁচিয়ে রাখা হতো। মধ্যযুগে হুক্কা ক্লান্তি নিবারক এবং হাল্কা নেশার অন্যতম মাধ্যম হিসেবে বিবেচিত হত। গ্রামের যে কোন আড্ডায় অনুষ্ঠানে হুক্কা দিয়ে আপ্যায়ন পর্ব শুরু হত। পরিবারের যে কোন আনুষ্ঠানিক আসরে মেহমান আপ্যায়নে হুক্কা ছিল অন্যতম উপকরণ। শীতকালে মোড়ল বাড়ি থেকে শুরু করে জমিদার বাড়ি পর্যন্ত হুক্কা টানার ধুম পরে যেত। চাদর মুড়ি দিয়ে গ্রামের লোকেরা একত্রিত হয়ে একজনের মুখ থেকে আর একজন ভাগাভাগি করে হুক্কা টানতেন। এতে পারস্পারিক বন্ধুত্ব আরও নিবিড় হয়। হুক্কা বাংলার সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যের অন্যতম নিদর্শন। বাঙ্গালীদের অসাধারণ ঐতিহ্যের এই নিদর্শণ এখন জকিগঞ্জের কোথায়ও চোঁখে পড়ে না। ধূমপানের নিরাপদ মাধ্যম হুক্কার স্থান দখল করে নিয়েছে বিড়ি, সিগারেট, চুরুট, পাইপসহ আরও নানা ক্ষতিকারক উপকরণ। তাই বর্তমান সময়ের তরুন প্রজন্ম হুক্কা সম্পর্কে তেমন কিছুই জানেনা। অবশ্য কোন কোন সৌখিন পরিবারে ঐতিহ্যের নিদর্শন হিসেবে শোকেসে হুক্কাসহ বাঙ্গালী ঐতিহ্যের অনেক বিলুপ্ত উপকরণ সাজিয়ে রাখা হয়। কিন্তু আধুনিক প্রজন্মের কাছে হুক্কা অনেক আগেই ইতিহাসের পাতায় উঠে গেছে। তারা হুক্কা কখনো চোখেও দেখেনি। মাঝে মাঝে অবশ্য টিভি সিনেমার পর্দায় হুক্কার দেখা মিলে। কিন্তু বাস্তবে জকিগঞ্জের গ্রাম-গঞ্জে হুক্কার দেখা মেলা মুশকিল।
0 মন্তব্য:
Speak up your mind
Tell us what you're thinking... !