জাহানারা চৌধুরী ঝর্ণা
জকিগঞ্জের বিয়ে গুলোতে পালকি এখন আর চোঁখে পড়েনা। অথচ এক সময় পালকি ছিল গ্রামের মেয়েদের বহুদিনের লালায়িত প্রেম, প্রীতি আর অমোঘ ভালবাসা। পালকি থাকতো গ্রামের নারীদের প্রতিটি অনুভূতির সাথে জড়িত। চারকোনা বিশিষ্ঠ পালকি বহন করতো চার জন পুরুষ। দুরত্ব ভেদে তাদের হাতে শোভা পেত লাঠি কিংবা দেশীয় অস্ত্র। ক্ষেত্র বিশেষে পালকির বাড়তি বেয়ারাও থাকতো। পালকি বহনের পেশাকে ঘিরে বেয়ারা সম্প্রদায় নামে আলাদা একটা সম্প্রদায়ও গড়ে উঠেছিল। হেলে-দুলে পালকি নিয়ে চলতে বেয়ারারা ‘হেইয়াহ হেইয়াহ’ রব তুলে পথিকের দৃষ্টি আকর্ষণ করতো। ছন্দের জাদুকর সত্যেন্দ্র নাথ দত্তের ভাষায়, রবীন্দ্রনাথের কবিতায়, হেমন্তের গানে পালকি এখন ঐতিহ্যের খাতায় নাম লেখাচ্ছে। সেই ন্যাংটা পুঁটো ছেলেটা আর বলে না পালকি চলে, পালকি চলে, আদুল গায়ে যাচ্ছে কারা, যাচ্ছে কারা হনহনিয়ে। রবি ঠাকুরের ’বীরপুরুষ’ কবিতার খোকা তার মাকে পালকিতে নিয়ে যাওয়ার সময় লড়েনা ডাকাতের সাথে যখন ওরা আসে তেড়ে ‘হারে রে রে’ বলে। সেই ভীষণ যুদ্ধের বর্ণনাও দিতে পারে না মাকে। মাও বলতে পারেন না, ভাগ্যে খোকা ছিল তাঁর সাথে। দাদা তার সদ্য বিয়ে হওয়া দিদিটিকে আর বলে না, এ কটা দিন থাক না দিদি, কেঁদে কেটে কঁকিয়ে, দুদিন বাদে তো নিয়েই যাবে পালকি করে সাজিয়ে। আধুনিক প্রযুক্তির যানবাহনের যুগে জকিগঞ্জের গ্রাম-গঞ্জ থেকে হারিয়ে গেছে হাজার বছরের ঐতিহ্য ‘পালকি’। অথচ মাত্র কয়েক বছর পূর্বে গ্রামের বিয়ের বর-বধুকে বাহনের অন্যতম বাহন ছিল এই পালকি। পালকির সঙ্গে মিশে ছিল মধুময় এক স্বপ্ন। গায়ের পথে পালকি করে নববধুকে নিয়ে যাওয়ার দৃশ্য দেখতে গ্রামের ছেলে-মেয়েরা রাস্তায় আর বৌ-ঝিয়ের বাড়ির ভিতর থেকে উঁকি-ঝুকি মারত। পালকির মধ্যে বসা বৌকে দেখে তারাও হারিয়ে যেত কল্পনার রাজ্যে। চার বেয়ারা পালকি কাঁধে নিয়ে ছন্দ তুলে বৌকে নিয়ে যেত বাংলার শ্যামল মেঠো পথে। এ যুগের বধুরা আর পালকিতে লজ্জারাঙা মুখে শ্বশুর বাড়িতে যায় না। শ্যামল বাংলা, সেই মেঠো পথ, নতুন বধু সবই আছে, কিন্তু যান্ত্রিক যুগে নেই শুধু পালকি। পালকির ব্যবহার কিভাবে কখন এদেশে শুরু হয়েছিল তা সঠিকভাবে জানা যায়নি। তবে মোঘল ও পাঠান আমলে বাদশাহ, সুলতান, বেগম ও শাহাজাদীরা পালকিতে যাতায়াত করত বলে জানা গেছে। ইংরেজ আমলের নীলকররা পালকিতে করে এক স্থান থেকে অন্যস্থানে ঘুরে বেড়াতো। আর সেজন্যই পালকি অভিজাত শ্রেনীর বাহন হিসেবে গন্য করা হতো। পালকি দেখতে অনেকটা কাঠের বাক্সের কাঠামো। দৈর্ঘ্য ৬ ফুট প্রস্থ তার অর্ধেক কাঠামো লম্বা দুপাশে বাঁশের সাহায্যে গাঁথা। পালকির উপরে দামী কাপড় দ্বারা মোড়ানো থাকত। তৎকালীন বাঙ্গালির সংস্কৃতিতে পালকির অবস্থান ছিল সুদৃঢ়। আগের দিনে বিত্তশালী পরিবারগুলোতে নিজস্ব পালকি ও বেয়ারা থাকত। আর নিম্নবিত্তরা তাদের বৌ-ঝিদের আনা নেয়ার জন্য ভাড়া করত পালকি। অন্যসব কাজে পালকি ব্যবহার হলেও বিয়ে-সাদিতে পালকির ব্যবহার ছিল অপরিহার্য্য। জকিগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে এক সময় পালকির প্রচলন ছিল। গ্রামের বিভিন্ন অনুষ্ঠান ছাড়াও বিয়েতে অন্যতম বাহন ছিল পালকি। পালকি জকিগঞ্জ উপজেলার কোথাও এখন আর দেখা যায় না। বর্তমানে পালকির প্রচলন না থাকায় এ পেশার সাথে জড়িতরা জীবন-জীবিকার তাগিদে অন্যান্য পেশা বেছে নিয়েছে। ফলে কালের পরির্বতনে নতুন প্রজন্ম ভুলে যেতে শুরু করেছে পালকিসহ বিভিন্ন জিনিস পত্রের ব্যবহার। হয়তো এক সময় পালকি কি সেটিও প্রজন্ম জানবে না। জানবে না বিয়ে করে বধুকে পালকিতে বসিয়ে বর পায়ে হেটে কিংবা ঘোড়ায় চেপে নববধুকে বাড়ীতে আনার সেই ঐতিহ্যবাহী সময় টুকু কত মধুর। ডিজিটাল যুগে নতুন আধুনিক রকমারি যানবাহনের মাঝে হারিয়ে গেছে ঐতিহ্যবাহী সেই পাড়া-গাঁয়ের মেয়েদের স্বপ্নের পালকি।
0 মন্তব্য:
Speak up your mind
Tell us what you're thinking... !