জাহানারা চৌধুরী ঝর্ণা
গোলা ভরা ধান, পুকুর ভরা মাছ ও গোয়াল ভরা গরু, গ্রাম বাংলার কৃষকদের প্রাচীন ঐতিহ্য হলেও বর্তমান আধুনিকতার ছোয়ায় সেই ঐতিহ্য জকিগঞ্জ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। এক সময় গরু ছাড়া কৃষি কাজ অসম্ভব ছিল বিধায় বাধ্য হয়ে কৃষকেরা গরু পালন করতো। এখন আধুনিকতার ছোয়া এবং কৃষি জমির স্বল্পতার কারণে গরু পালন ছেড়ে দিয়েছেন অনেক কৃষক। তারা এখন কৃষি কাজে ব্যবহার করছেন বিভিন্ন ধরণের ট্রক্টরসহ উন্নত বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি। কিছুদিন পূর্বেও জকিগঞ্জের গ্রাম-গঞ্জে গরু দিয়ে হালচাষ, ধান মাড়াই ও কৃষিপন্য বহন করা হত। এখন সেই দৃশ্য তেমন একটা চোঁখে পড়েনা। এখন কৃষক ভোর বেলার পান্তা ভাত, মরিচ পোড়া খেয়ে গরু, লাঙ্গল জোয়াল ও মই কাঁধে নিয়ে জমি চাষের উদ্দেশ্যে বের হয়না। প্রযুক্তির অগ্রগতির ফলে এখন কৃষক মোবাইল ফোনে ট্রাক্টর মালিকের সাথে চুক্তি করে জমি চাষ করে। আজ যুগের পরিবর্তনের ছোয়া কৃষকদের রন্দ্রে রন্দ্রে লেগেছে। আর সে জন্যই খুব একটা দেখা যায় না গরু দিয়ে চাষাবাদের এক সময়কার গ্রাম বাংলার চিরায়িত দৃশ্য। জকিগঞ্জের কৃষকরা এক সময় চিন্তাও করতে পারেনি সভ্যতার ক্রমবিকাশ এবং অত্যাধুনিক কৃষি সরঞ্জাম গরু দিয়ে হালচাষের বিকল্প হয়ে উঠবে। বর্তমানে এ উপজেলার প্রায় ৯০ ভাগ কৃষক কৃষির আধুনিক সরঞ্জাম দিয়ে জমি চাষাবাদ করে আসছেন। অনেকে আবার এসব যন্ত্রপাতি অন্যের কাছে ভাড়া দিয়ে দু’পয়সা আয়ও করছেন। সে কারণে জকিগঞ্জ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে লাঙ্গল, জোয়াল, গরু, ও মই দিয়ে জমি চাষের অপূর্ব দৃশ্য। বলা যায়, আজ আর পুরোনো সেই কৃষি উপকরণের প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে। কারণ যেখানে আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতি দিয়ে অতি অল্প সময়ে এবং সল্প খরচে কৃষক জমি চাষ দিতে পারছেন সেখানে একালের হিসেবী ও শিক্ষিত কৃষক অতিরিক্ত সময় ও অর্থ ব্যয় কেন করবেন? এক সময় যারা লাঙ্গল, জোয়াল ও মই তৈরী করে জীবিকা নির্বাহ করতেন এখন তারা অলস সময় কাটাচ্ছেন। আগের মত আর তাড়া নেই তাদের জীবনে। অথচ এমন একদিন ছিল যখন তাদের ব্যস্ততার শেষ ছিলনা। পরিস্থিতির কারণে বর্তমানে অনেকেই পেশা বদল করেছেন। তবে কেউ কেউ এখনও লাঙ্গল, জোয়াল ও মই তৈরী করে তা বাজারে পসরা সাজিয়ে বসেন। তবে বিক্রি আগের চেয়ে অনেক কম জানালেন জকিগঞ্জ উপজেলার কালিগঞ্জ বাজারের এক ব্যবসায়ী। তবে গ্রাম-গঞ্জের কৃষক-কৃষাণীর পরিশ্রম অনেক কমে যাওয়ায় এখন মেদ, ভুরি, উচ্চ রক্তচাপ এবং ডায়াবেটিকস রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন সচরাচর। গ্রামের আনন্দ ভূলতে বসেছে গ্রামে বেড়াতে আসা শহর-বন্দরের মানুষেরা। কালের বির্বতনে এখন এসব হারিয়ে যেতে বসেছে জকিগঞ্জের প্রায় প্রতিটি গ্রাম থেকে। এই নিয়ে রাজধানী ঢাকা ও সিলেট থেকে গ্রামে বেড়াতে আসা বেশ কয়েকজন জানান, আগের দিনের গ্রামের আনন্দ ছিল অন্য রকম। মানুষের প্রতি মানুষের সহমর্মিতা, ভ্রাত্রিত্ববোধ ও সরলতা মাখানো ভালবাসা ছিল ভিন্ন। গ্রামের কথা মনে পড়লেই ছুটে আসার জন্য মনটা পাগল হয়ে যেত। আজ আর আগের সেই দৃশ্যপট গ্রামে এসে দেখতে পাইনা। শীতের সকালের কাঁচা রোদে বসে মুড়ি ও খেজুরের রস খেতে যে আনন্দ লাগতো সে আনন্দ আর এখন গ্রামে পাইনা। এখন গ্রাম-গঞ্জে পাকা বিল্ডিং আর অনেকের বাড়ীতে গ্রীলের বারান্দায় ইচ্ছে করলেও অনুমতি ছাড়া প্রবেশ করা যায়ন। শহর থেকে গ্রামে এসে খালী গায়ে গামছা গলায় দিয়ে বাড়ী বাড়ী ঘুরে চাচা, চাচী ডেকে গাছের তাজা ফল খাওয়া আর হয়ে উঠে না। এসকল দিক বিবেচনায় মনে হয়, গ্রাম-গঞ্জের সেই পুরোনো ঐতিহ্যটা থাকা মজার ছিল। এব্যাপারে কয়েকজন প্রবীন কৃষক বলেন, বর্তমান জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে চাষাবাদের জমি ও ভিটে বাড়ীর স্বল্পতার দরুন গরু পালন করা সম্ভব হচ্ছে না। অন্যদিকে কৃষি কাজ লাভজনক না হওয়ায় কৃষি কাজ ছেড়ে দিতে হয়েছে। পাশাপাশি গো খাদ্যের মূল্য বৃদ্ধি এবং গোচারণ ভূমির স্বল্পতায় ঘরে ঘরে আর গরু পালন করা হয়না। অনেকে দুধ খাওয়ার স্বার্থে বা শখের বশে গরু পালন করলেও অতিতের মত এখন গরু চোঁখে পড়েনা। এ সকল বিষয়েই জকিগঞ্জ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য গরু দিয়ে হাল চাষ।
0 মন্তব্য:
Speak up your mind
Tell us what you're thinking... !