স্টাফ রিপোর্টার
সিলেট জেলা শহর থেকে প্রায় শতকিলোমিটার দূরবর্তী একটি থানা জকিগঞ্জ। এ থানায় রয়েছে পৃথক অনেক ইতিহাস ও ঐতিহ্য। এখানকার মানুষ ধর্মপ্রাণ ও শান্তি প্রিয় বলে পরিচিত। কিন্তু বিগত কয়েক বছর থেকে এ থানায় আকষ্মিকভাবে অপরাধ প্রবণতা বাড়তে শুরু করেছে। ফলে সচেতন মহল এনিয়ে ভাবতে শুরু করেছেন। কেননা গত এক বছরে জকিগঞ্জে প্রায় এক ডজনের কাছাকাছি খুনের ঘটনা ঘটেছে। চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, নারী নির্যাতন, ধর্ষণ ও মাদক চোরাচালানসহ নানাবিধ অপরাধ প্রায় প্রতি মাসেই ১/২টি ঘটেছে। যার দরুন থানার সাধারণ মানুষের মধ্যে এক ধরণের আতংক বিরাজ করছিলো। থানার সদ্য বিদায়ী ওসি মোঃ ইউনুছ মিয়া যোগদানের পর প্রথমদিকে আইন শৃংখলার বেশ উন্নতি হলেও শেষ দিকে ৪/৫টি খুনসহ বেশ কয়েকটি চুরি-ডাকাতির ঘটনায় বির্তকিত হয়ে উঠেন। পরবর্তীতে গত ৪ এপ্রিল জকিগঞ্জ থানায় নতুন ওসি হিসেবে যোগদান করেন মোঃ জামশেদ আলম। তিনি যোগদানের পর এ পর্যন্ত কোন খুনের মতো জঘন্য অপরাধ না ঘটলেও চুরি-ডাকাতি অব্যাহত রয়েছে। বিগত মাসের পত্রিকা ঘেটে দেখা যায়, গত ২৫ এপ্রিল শুক্রবার গভীর রাতে জকিগঞ্জের কাজলসার ইউনিয়নের জামালপুর গ্রামে ডাকাতের হামলায় একই পরিবারের ৪ জন আহত হন। ডাকাতের হামলার শিকার পরিবারের সদস্য হিরা লাল বিশ্বাস জানান- রাত অনুমান দুইটার দিকে ১৪/১৫ জনের ডাকাতদল তাদের বাড়ীতে হামলা চালায়। ঘরের দরজা ভেঙ্গে ঘরে প্রবেশ অস্ত্রের মুখে তার ভাই মতিলাল বিশ্বাস (৬০) ও ভাতিজা বিভাস বিশ্বাস (৩০) চাচাত ভাই কুটেশ বিশ্বাসের ছেলে অপু কান্ত বিশ্বাসকে মারধোর করে হাত পা বেঁধে ফেলে। ডাকাতের আক্রমন ঠের পেয়ে পাশের কক্ষে শুয়ে থাকা শুভ্র কান্তি বিশ্বাস চিৎকার করলে ডাকাতদল কুপিয়ে তাকে মারাতœক জখম করে। এ সময় বাড়ীর লোকজনের সুর চিৎকারে আশপাশের লোকজন এগিয়ে এলে ডাকাতদল পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। যাবার সময় ডাকাতরা চারটি মোবাইল ফোন ও কিছু সোনা গয়না নিয়ে যায়। বিষয়টি পুলিশকে অবহিত করা হয়েছে। এর মাত্র ৪ দিনের মাথায় একই ইউনিয়নের কামালপুর গ্রামের প্রবাসী আসহাব উদ্দিনের বাড়িতে গভীর রাতে ১৩/১৪ জনের একদল ডাকাত ঢুকে পড়ে। এ সময় তারা বাড়ির পূর্বের ঘরে ঢুকে ঘুমন্ত লজিং মাস্টারকে মরধর করে তার নগদ টাকা ও মোবাইল সেট নিয়ে তাকে বেঁধে রেখে মূল ঘরের দরজা ভাঙ্গতে শুরু করে। ডাকাতের টের পেয়ে প্রবাসী আসহাব উদ্দিন তাদের প্রতিহত করতে গেলে ডাকাতদের হামলায় তিনিসহ তার মা-বাবা মারাত্মক আহত হন। এরই মধ্যে বাড়ির মহিলারা মোবাইলে স্থানীয় লোকদের বিষয়টি জানালে লাঠি সোটা নিয়ে এলাকাবাসী ছুটে আসেন। এলাকার লোকজনের টের পেয়ে ডাকাতদল পালিয়ে যায়। এ বিষয়ে জকিগঞ্জ থানা পুলিশ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছে। সম্প্রতি জকিগঞ্জের বিরশ্রী ইউনিয়নের পীরনগর গ্রামে গভীর রাতে প্রবাসী আমির উদ্দিনের বাড়িতে এক দুর্ধর্ষ ডাকাতি সংঘটিত হয়। এ সময় ডাকাতদের হামলায় ৩ জন আহত হয়েছেন। জানা গেছে ৯-১০ জনের মুখোশপড়া ডাকাতদল ঘরে প্রবেশ করে মহিলা ও শিশুদের অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে আলমিরা ও শোকেস এর চাবি সংগ্রহ করে। চিৎকার শুনে বাড়ির মালিক মোঃ ছালিক মিয়া ও তার দুই ভাগিনা আনসার উদ্দিন, আলী হোসেন এগিয়ে আসলে দেশীয় অস্ত্রের আঘাতে তাদের রক্তাক্ত জখম করে। অভিযানে ডাকাতেরা সাড়ে ১০ ভরি স্বর্ণ, নগদ ৮৫ হাজার টাকা, ৬টি মোবাইল সেট, কাপড়-চোপড়সহ অন্য জিনিসপত্র নিয়ে পালিয়ে যায়। পুলিশ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছে। তবে উপরোক্ত ঘটনাগুলো ডাকাতি না প্রতিহিংসা মূলক কিছু তা নিয়ে চলছে নানা আলোচনা ও সমালোচনা। অনেকের মতে এই ঘটনাগুলো ডাকাতি নয় তা প্রতিহিংসা বা পূর্ব শত্র“তার জেরধরে সংঘটিত হয়েছে। এছাড়া ওসির যোগদানের মাত্র একদিনের মাথায় গত ৬ এপ্রিল জকিগঞ্জের মানিকপুর ইউনিয়নের সিরাজপুর গ্রামের রঞ্জিত দাসের বসত ঘর পুড়িয়ে দিয়েছে প্রতিপক্ষ। স্থানীয়রা জানান শৈলজুড়ি জলমহাল নিয়ে মনসুরপুর গ্রামের নজমূল ইসলামের পুত্র শ্রমিকদল নেতা ফেরদৌস আহমদ ও সিরাজপুর গ্রামের রঞ্জিত দাস গত ৬ এপ্রিল রোববার উপজেলা পরিষদ প্রাঙ্গনে কথা কাটাকাটি করেন। এরই জের ধরে ফেরদৌস আহমদ ও তার সহযোগিরা মিলে ঐদিন রাত সাড়ে ১০টায় পেট্রল দিয়ে দিনমজুর রঞ্জিত দাসের বসত ঘর পুড়িয়ে দেয়। ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা ঘটনাস্থলে গিয়ে আগুন নেভানোর চেষ্টা করলেও ততক্ষণে সব কিছু পুড়ে ছাই হয়ে যায়। ঘটনার পর পুলিশ রাত দুইটায় স্থানীয় হাওর থেকে জড়িত ফেরদৌসকে আটক করে। এ ঘটনায় দু’জনকে আসামী দিয়ে মামলা দায়ের করা হয়েছে। মামলা নং-৭। সম্প্রতি জকিগঞ্জের কসকনকপুর ইউনিয়নের লক্ষীরারচকে রাতে পেট্রল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয় দুর্বৃত্তরা। এতে পাকা টিনসেডের সাতটি ঘর পুড়ে ছাই হয়ে যায়। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ অন্তত ৩০ লাখ টাকা। বাড়ির মালিক হাজী ইয়াকুব আলী চৌধুরী জানান, বাড়িতে আমি ছাড়া বাকি সবাই ছিলেন পাশ্ববর্তী ছালেহ পুর গ্রামে একটি অনুষ্ঠানে। রাত অনুমান সাড়ে নয়টায় বৃষ্টির শব্দ শুনতে পাই। জানালায় উকি দিলে বৃষ্টির কোন চিহৃ পাইনি। কিছুক্ষণ পরই আগুনের লেলিহান শিখা আমার মাথার উপরে। কোন মতে ঘর হতে বের হলে আমি প্রাণে বেঁচে যাই। কিন্তু মাত্র ১৫মিনিটে সাতটি ঘরে রাখা সব কিছু মালামাল আগুনে পুড়ে ছারখার হয়ে যায়। আগুনে নগদ ৮০হাজার টাকা, স্বর্ণ ছয় তোলা, দু’টি ল্যাপটপ, ডিভিডি প্লেয়ার, তিনটি মোবাইল সেট, দু’টি শোকেস, ওয়ারড্রপ, তিনটি বক্স পালংক, ১১টি কম্বল, দামি কাপড়চোপড়হ অসংখ্য প্রয়োজনীয় আসবাবপত্র পুড়ে যায়। তিনি জানান ছেলেরা প্রবাসে থাকায় আমার প্রতি ঈর্ষান্বিত হয়ে কেউ এসব ঘটনা ঘটাতে পারে। সম্প্রতি আমার এক ছেলে দুবাই থেকে এসেছে। তাকে বিয়ে দেব সে জন্য অনেক মালামাল এনেছিল সব কিছু পুড়ে গেছে। খবর পেয়ে থানা পুলিশ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। এছাড়া জামায়াত-পুলিশ সংঘর্ষ, মাদক চোরাচালান, নারী নির্যাতন ও ছোটখাটো মারামারির ঘটনাসহ বেশ কয়েকটি অপরাধ সংঘঠিত হয়েছে। এরপরও নবাগত ওসির সফলতার পাল্লা ভারী বলে অনেকে জানান। খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, ওসি মোঃ জামশেদ আলম যোগদানের পর যে ক’টি অপরাধ সংঘটিত এর সব ক’টির হোতাদের আইনের আওতায় আনা হয়েছে। জানা যায়, জামায়াত-পুলিশ সংঘর্ষের ঘটনায় দায়েরকৃত পুলিশ এসল্ট মামলায় ৪ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ছিনতাইকৃত ১ লাখ টাকা মাত্র আধা ঘন্টার মধ্যে উদ্ধার করে পুলিশ। ৭ জন ডাকাত, গ্রেফাতারি পরোয়ানা ও রিকলসহ ৯৫ জন আসামীকে গ্রেফতার করা হয়। ভারতীয় ৬৩ হাজার নাসির বিড়ি, আড়াই কেজি গাজাঁ, ১৯০ বোতল ফেন্সিডিল ও ১০বোতল পরিত্যক্ত অফিসার চয়েজ উদ্ধার করা হয়। শাহবাগ এলাকা থেকে ৬ জুয়াড়ি ধরে ভ্রাম্যমান আদালতে হাজির করার পর ১ মাসের সশ্রম কারাদন্ড প্রদান করা হয়। প্রায় প্রতিটি বাজার থেকে গাফলা, তীর ও কেরামসহ বিভিন্ন ধরনের জুয়া খেলা বন্ধে পুলিশের তৎপরতা দেখা যায়। বিভিন্ন স্থান থেকে এসব খেলার সরঞ্জামও উদ্ধার করা হয়। হোটেলে অবৈধভাবে অশ্লীল ছবি দেখানো বন্ধে জোরালো পদক্ষেপ নেয় পুলিশ। একই সাথে ওসি জমসেদ আলম যোগদানের পর উপজেলার ছয়টি স্থানে আইন শৃংখলা বিষয়ে স্থানীয় জনগণকে নিয়ে মতবিনিময় সভা করা হয়। বিশেষ করে প্রতিদিন রাতে পুলিশের টহল এখন চোঁখে পড়ার মতো। যাতে কোথাও কোন অপরাধ সংঘটিত না হয় সে ক্ষেত্রে পুলিশের বর্তমান ভূমিকা প্রশংসনীয় বলে স্থানীয়রা মনে করেন।
0 মন্তব্য:
Speak up your mind
Tell us what you're thinking... !