ডেক্স রিপোর্টঃ
দুদকের দুর্নীতি মামলার ফেরারি আসামি এক সময়ের দুর্দ-প্রতাপশালী বিএনপি নেতা হারিছ চৌধুরী নিজেকে ধরাছোঁয়ার বাইরে রাখতে একেক সময় একেক দেশে আত্মগোপন করছেন। চারদলীয় জোট সরকার আমলে একাধারে বিএনপির যুগ্মমহাসচিব প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক সচিবের দায়িত্বে থেকে বেপরোয়া দুর্নীতির মাধ্যমে অঢেল ধন-সম্পত্তির মালিক বনে যান। ওয়ান ইলেভেনের পর যৌথবাহিনীর হাতে গ্রেফতার এড়াতে প্রথমে ভারতে অবস্থান নেন। কিন্তু সেখানেও নিরাপত্তাবোধ না করায় থাইল্যান্ড ও সিঙ্গাপুর হয়ে চলে যান লন্ডনে। পরে লন্ডন থেকে অস্ট্রেলিয়া যান তিনি। বর্তমানে তিনি ইরানে অবস্থান করছেন। সেখানে তিনি তাঁর ছোটভাই ডা. আবদুল মুকিত চৌধুরীর আশ্রয়ে আছেন বলে জানা গেছে। প্রসঙ্গত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার আমলে ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু ছিল প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ও বিএনপি চেয়ারপার্সনের রাজনৈতিক কার্যালয় হাওয়া ভবন। এ দু’জায়গায়ই তার অবস্থান ছিল অত্যন্ত সুদৃঢ়। এ কারণে সরকার ও বিএনপির সর্বস্তরে তার অবাধ বিচরণ ছিল। আর এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে তিনি বেপরোয়া দুর্নীতির মাধ্যমে টাকার পাহাড় গড়ে তোলেন। রাজধানী ঢাকা ও সিলেটে ১৮টি বাড়ি নির্মাণ করেন। বিএনপি আমলে হাওয়া ভবন ও প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের দাপট খাটিয়ে সরকারী বাড়ি ও জমি দখল করা, নিয়োগ বাণিজ্য, বদলি-পদায়ন, বড় বড় টেন্ডার পাইয়ে দেয়া, চাঁদাবাজি, মানিলন্ডারিং, বন বিভাগের অনুমতি ছাড়া নিজ বাড়িতে হরিণসহ বিভিন্ন প্রজাতির বন্যপ্রাণী রাখাসহ বিভিন্ন কর্মকা-ের মাধ্যমে শীর্ষ দুর্নীতিবাজদের তালিকায় তার নাম উঠে আসে। এমনকি জঙ্গী মদদসহ নানা অঘটনেও তার নাম যুক্ত হয়। এ কারণে ওয়ান ইলেভেনের পর খবরের শিরোনাম হয়েছিলেন হারিছ চৌধুরী। এ কারণে তাঁকে ধরতে যৌথবাহিনী সারাদেশে তল্লাশি চালায়। কিন্তু নিজের অপকর্মের পরিণতি কি হতে পারে তা আঁচ করতে পেরে আগে ভাগেই সিলেট সীমান্ত পাড়ি দিয়ে প্রথমে ভারতের করিমগঞ্জে মামার বাড়িতে আশ্রয় নেন। সেখান থেকে পরে লন্ডনে চলে যান। এক সময় লন্ডনেও নিজেকে নিরাপদ মনে না করে তিনি চলে যান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। ওখানে কিছুদিন থাকার পর চলে যান অস্ট্রেলিয়ায়। এর পর আরও নিরাপদে থাকার জন্য চলে যান ইরানে। বর্তমানে তিনি সেখানেই অবস্থান করছেন বলে জানা গেছে। তবে অনুকূল পরিবেশ ফিরে এলে তিনি দেশে আসবেন। ২০০৭ সালের জানুয়ারি মাসে দেশত্যাগের পর দীর্ঘ সাত বছর ধরে সরকারের বিভিন্ন সংস্থা তাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। দলীয় লোকজনসহ তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে এমন লোকরাও তাকে হন্যে হয়ে খুঁজছে। আবার তার দুর্নীতির কারণে যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তারাও তাকে খুঁজছে। কিন্তু কোন একটি দেশে আছেন এমন তথ্য পেয়ে খুঁজতে গিয়ে আর তাকে পাননি। কারণ, তাঁর আগেই তিনি অন্য দেশে পাড়ি দেন। এমনকি সরকারের গোয়েন্দারাও তার ব্যাপারে সরকারের কাছে সুনির্দিষ্ট কোন তথ্য দিতে পারছেন না। আর বিএনপি নেতাকর্মীরাও এখন তাঁর খোঁজখবর রাখছেন না। এমনকি বিএনপি নেতাকর্মীদের কাছে তাঁর বিষয়ে জানতে চাইলে তাঁরা বিরক্তি প্রকাশ করেন। সিলেটের অধিবাসী হওয়ায় হারিছ চৌধুরী যখন যে দেশে যান সেখানেই বাড়তি কিছু সুবিধা পেয়ে যান। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সিলেটের লোক রয়েছেন। আর বিদেশের মাটিতে এক সিলেটী আরেক সিলেটীকে পেলে সমাদর করেন এটা ওই এলাকার মানুষের রেওয়াজ। এছাড়া হারিছ চৌধুরীর অনেক আত্মীয়স্বজনও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রয়েছেন। হারিছ চৌধুরী বিদেশে পালিয়ে বেড়ালেও ঘনিষ্ঠ আত্মীয় স্বজনের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছেন। এমনকি দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিরও খোঁজখবর রাখছেন। রাজনৈতিক পরিস্থিতি অনুকূলে এলে দেশে ফিরে আসার ইচ্ছেও প্রকাশ করেন। ২০১২ সালের ৭ ডিসেম্বর হারিছ চৌধুরীর ছোটভাই আল-রাজি ব্যাংকের সাবেক কর্মকর্তা আবুল হাসনাত চৌধুরী ঢাকায় হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। তার দাফন সম্পন্ন হয় গ্রামের বাড়ি সিলেটের কানাইঘাট উপজেলার দর্পনগর গ্রামে। ওই সময় হারিছ চৌধুরী ও তাঁর ছোটভাই আবদুল মুকিত চৌধুরী ইরান থেকে ফোনে আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে ক’বার কথা বলেন। এখনও মাঝে মধ্যে ঘনিষ্ঠ আত্মীয়দের সঙ্গে কথা বলেন। সূত্রমতে, হারিছ চৌধুরী এখন ইরানে অবস্থান করলেও লন্ডনে তার ব্যবসা রয়েছে। এ কারণে মাঝেমধ্যে লন্ডনে যান। এ ছাড়া তাঁর স্ত্রী জোসনা বেগম, ছেলে নাঈম চৌধুরী জনি এবং মেয়ে সামিরা তানজিম বর্তমানে লন্ডনে আছেন। যুক্তরাজ্যের নর্থ লন্ডনের উডগ্রীনের বিলাসবহুল একটি বাড়িতে হারিছ চৌধুরীর স্ত্রী-সন্তানরা বসবাস করছেন। বাড়িটি হারিছ চৌধুরীর নিজের অর্থে কেনা। ছেলে লন্ডনে নরওয়েভিত্তিক একটি তেল কোম্পানিতে কর্মরত এবং মেয়ে আইন পেশায় নিয়োজিত। হারিছ চৌধুরীরা চার ভাই, পাঁচ বোন। ছোট এক ভাই মারা গেলেও অন্য ভাইয়েরাও দেশের বাইরে থাকেন। জটিল চর্মরোগসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হারিছ চৌধুরী এখন নিয়মিত চিকিৎসা নিচ্ছেন। সে সঙ্গে চারদলীয় জোট আমলের বেপরোয়া দুর্নীতির কথা ভাবতে গিয়ে চেহারায় মলিনতা এসে গেছে বলে জানা গেছে। তবে দুর্নীতি করে কামানো টাকার অধিকাংশই ক্ষমতায় থাকাকালেই বিদেশে পাচার করে দেয়ায় তার এখন আর্থিক সঙ্কট নেই। এ ছাড়া লন্ডনে অন্য লোক মারফত তিনি যে ব্যবসা করেন তা থেকেও ভালই আয় হয়। এ ছাড়া দেশে বিভিন্ন লোকের কাছে পাওনা অর্থেরও একটি অংশ তিনি বিদেশে বসে হাতিয়ে নিয়েছেন বলে জানা গেছে। হারিছ চৌধুরীর ১৮টি বাড়ি থাকলেও তিনি গুলশান-২ এর ৫৩ নম্বর সড়কে ইন্দোনেশিয়ার দূতাবাসের কাছে ৬ নম্বর বাড়িতে থাকতেন। সরকারী এ বাড়িটি তিনি ক্ষমতার দাপটে দখল করেছিলেন। অভিজাত এ বিশাল বাড়ির আঙিনাতেই তিনি অবৈধভাবে হরিণ পুষেছিলেন। দোতলা ওই বাড়িটি এখন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নামে। এ ছাড়া আগেই হারিছ চৌধুরী তাঁর স্থাবর সম্পত্তির বেশিরভাগই তার ছেলে, মেয়ে ও স্ত্রীর নামে দিয়ে দিয়েছেন। দেশের বাইরেও তাঁর একাধিক বাড়ি রয়েছে বলে জানা গেছে। বর্তমানে ইরানে আত্মগোপনে থাকা হারিছ চৌধুরী একুশ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার আসামি। এ ছাড়াও তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে তাঁর বিরুদ্ধে একাধিক মামলা হয়। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) প্রথম ৫০ দুর্নীতিবাজের তালিকায় পাঁচ নম্বরে হারিছ চৌধুরী। দুদক তার বিরুদ্ধে বেশক’টি মামলা করে। কয়েকটি মামলায় সাজা হয় হারিছ চৌধুরীর। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার চার্জশীটে তাকে অভিযুক্ত করা হয়। এ ছাড়া জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলার পলাতক আসামি হারিছ চৌধুরীর বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে। ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি জরুরী অবস্থা জারির কয়েকদিন পর স্ত্রীকে নিয়ে সিলেটে গ্রামের বাড়িতে যান হারিছ চৌধুরী। যেদিন বাড়ি ফেরেন, সে রাতেই তাঁর ব্যক্তিগত সহকারী (পিএ) আতিক মোবাইল ফোনে ঢাকায় বিএনপি নেতাদের বাসায় যৌথ বাহিনীর অভিযান ও তল্লাশির কথা জানান। এ খবর পেয়ে হারিছ চৌধুরী স্ত্রীকে কানাইঘাট গ্রামের বাড়িতে রেখে সিলেট শহরের উদ্দেশে রওনা হন। তাঁর কয়েক ঘণ্টা পর যৌথবাহিনী হারিছ চৌধুরীর বাড়িতে অভিযান চালায়। এ অবস্থায় কয়েক দিন সিলেটের বিভিন্ন স্থানে আত্মগোপনে থাকার পর কাছের সীমান্তপথে আসামের (ভারত) করিমগঞ্জে মামার বাড়িতে চলে যান হারিছ চৌধুরী। হারিছ চৌধুরী বিএনপির রাজনীতি করলেও সব দলের প্রভাবশালী নেতাদের সঙ্গেই ভাল সম্পর্ক রাখার চেষ্টা করতেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালে হারিছ চৌধুরী ছাত্রলীগের রাজনীতিতে জড়িত ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর বড় ছেলে শেখ কামালের সঙ্গেও তাঁর ঘনিষ্ঠতা ছিল। ১৯৭৭ সালে জিয়াউর রহমানের ডাকে সাড়া দিয়ে যোগ দেন বিএনপিতে। এর পর সিলেট জেলা বিএনপির প্রথম কমিটির সাধারণ সম্পাদক, কেন্দ্রীয় যুবদলের সহসভাপতিসহ বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালন করেন তিনি। পরে তিনি বিএনপির যুগ্মমহাসচিব হন। আর চারদলীয় জোট সরকার আমলে প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক সচিবের দায়িত্ব পালন করেন। তবে স্থানীয় রাজনীতিতে সুবিধা করতে না পারায় তিনি কখনও সংসদ সদস্য হতে পারেননি। এ ব্যাপারে বিএনপির ৩ সিনিয়র নেতার কাছে জানতে চাওয়া হলে তারা বিতর্কিত সাবেক বিএনপি নেতা হারিছ চৌধুরী সম্পর্কে মন্তব্য করতে অপারগতা প্রকাশ করেন। হারিছ চৌধুরী কোথায় আছেন কি করছেন তাও তাঁরা জানেন না। সূত্র- দৈনিক আলোকিত বাংলাদেশ ও জনকণ্ঠ। ০৮ ও ১০ এপ্রিল-২০১৪ইং।
0 মন্তব্য:
Speak up your mind
Tell us what you're thinking... !